৮ই জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৪শে পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ৮ই রজব, ১৪৪৬ হিজরি

ইলিয়াস আলীকে অপহরণে জড়িত র‌্যাব সদস্য গুম রহস্য ফাঁস করলেন

সিলেট অঞ্চলে বিএনপির প্রভাবশালী নেতা এম ইলিয়াস আলীকে গুম করার পর হত্যা করে মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসানের নেতৃত্বে একটি ‘কিলিং স্কোয়াড’। হত্যার পর খুনিচক্র ইলিয়াস আলীর লাশ যমুনা নদীতে ফেলে দেয়। এই চাঞ্চল্যকর গুম ও হত্যার নির্দেশদাতা ছিলেন খোদ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ১৬৪ ধারায় দেওয়া স্বীকারোক্তিতে র‌্যাব সদস্য সার্জেন্ট তাহেরুল ইসলাম ইলিয়াস আলীকে অপহরণের পর লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিয়ে চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য দেন।

এ নিয়ে সোমবার একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে দৈনিক আমার দেশ।  সাংবাদিক অলিউল্লাহ নোমানের করা সেই প্রতিবেদনে চাঞ্চল্যকর ইলিয়াস আলী গুম ও হত্যার আদিঅন্ত তুলে ধরা হয়েছে।

১৬৪ ধারায় দেওয়া স্বীকারোক্তিতে তাহেরুল বলেন, জিয়াউল আহসানের নির্দেশে ঘটনার রাতে শেরাটন হোটেল থেকে তিনি ইলিয়াস আলীকে অনুসরণ করেন।

মহাখালী পৌঁছার পর জিয়াউল আহসান নিজেই আরেকটি টিম নিয়ে ইলিয়াস আলীর গাড়ি অনুসরণ করেন। ইলিয়াস আলীর গাড়ি বনানীর ২ নং সড়কের বাসার সামনে পৌঁছার আগেই বনানীর সাউথ পয়েন্ট স্কুলের সামনে থেকে তাকে তুলে নেওয়া হয়। ইলিয়াস আলীর সঙ্গে তার ড্রাইভার আনসারকেও অপহরণ করা হয়। গাড়িটি জলখাবার হোটেলের সামনে দিয়ে বনানীর ২ নম্বর সড়কে ঢোকার পরে এই অপহরণের ঘটনা ঘটে।

ট্রাইব্যুনাল সূত্র আরও জানায়, ইলিয়াসকে হত্যা ছাড়াও র‌্যাবের জিয়াউল আহসানের কিলিং স্কোয়াডের এক সদস্য একদিনে ১১ জন এবং আরেক সদস্য ১৩ জনকে খুন করেছিল। উল্লেখ্য, জিয়াউল আহসান তখন র্যাবে কর্মরত ছিলেন। বর্তমানে তিনি জেলে আটক রয়েছেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ও গুম তদন্ত কমিশন সূত্রে আরও জানা গেছে, ইলিয়াস আলীকে অপহরণের সঙ্গে জড়িত দুজন সেনাসদস্য বর্তমানে সেনাবাহিনীতে রয়েছেন। এরা হলেন— ওয়ারেন্ট অফিসার জিয়া ও ইমরুল। জিয়াউল আহসানের রানার হিসেবে গুম ও খুন মিশনের হুকুম তারা তামিল করতেন। খুনিচক্রের সদস্য হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার পর গুম তদন্ত কমিশন ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত টিমের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে সেনাবাহিনী এ দুই সদস্যকে ক্লোজড এবং অন্তরীণ করেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র নিশ্চিত করেছে।

২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল সন্ধ্যার পর দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে ইলিয়াস আলী সভা করেন তৎকালীন শেরাটন হোটেলে (বর্তমান ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল)। সভা শেষ করে রাত ১১টায় তিনি বের হন এবং গাড়িতে করে বাসায় ফিরছিলেন। অপহরণের লক্ষ্যে জিয়াউলের নির্দেশে শেরাটন থেকেই অনুসরণ করছিলেন র্যাবের সদস্য সার্জেন্ট তাহেরুল ইসলাম। পরবর্তীতে তাকে চিহ্নিত করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত টিম। তাকে তদন্ত কমিটিতে আনা হয়।

জিজ্ঞাসাবাদের পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ১৬৪ ধারায় তিনি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। জবানবন্দিতে তিনি উল্লেখ করেছেন, আমার দায়িত্ব ছিল শেরাটন থেকে অনুসরণ এবং বেতার বার্তায় গতিপথ জিয়াউল স্যারকে জানানো। নির্দেশনা অনুযায়ী তিনি ইলিয়াস আলীর গাড়ি অনুসরণ এবং প্রতিটি মুহূর্তে গাড়ির গতিপথ জিয়াকে অবহিত করেন। মহাখালী পৌঁছার পর ইলিয়াস আলীর গাড়ি সরাসরি অনুসরণ শুরু করেন জিয়ার টিম।

মহাখালী জলখাবার হোটেলের অদূরে বনানীর ২ নম্বর সড়কে গাড়িকে ধাক্কা দিয়ে থামানোর পর ড্রাইভার আনসারসহ ইলিয়াস আলীকে অপহরণ করে এই টিমের সদস্যরা। এরপরই জিয়া তাহেরুলকে বলেন, ‘তোমার ডিউটি শেষ, চলে যাও।’ নির্দেশনা অনুযায়ী দায়িত্ব শেষে তিনি ফিরে যান। জিয়ার টিম ইলিয়াস আলীকে নিয়ে যাওয়ার পর কী হয়েছে সেটা তিনি বলতে পারবেন না। ’

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ইলিয়াস আলীকে অপহরণের পর হত্যা করা হয়েছিল। হত্যার পর তৎকালীন র্যাব কর্মকর্তা এবং পরবর্তী সময়ে সেনাবাহিনীতে পদোন্নতি পেয়ে মেজর জেনারেল হওয়া জিয়াউল আহসান অফিসে ফিরে স্বস্তি ও আনন্দ প্রকাশ করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘আজ বড় একটি অপারেশনে সাকসেসফুল হলাম। শেষ করে তাকে যমুনায় ফেলে দিয়ে এসেছি।’

জিয়া এ কথাও বলেন যে, ইলিয়াস আলী অপারেশনের কথা ঊর্ধ্বতনকে জানিয়েছি। ঊর্ধ্বতন বলতে তিনি মেজর জেনারেল তারেক সিদ্দিকি কিংবা শেখ হাসিনাকে বুঝিয়েছেন বলে সূত্রের ধারণা। যাদের সামনে এই কথা জিয়াউল আহসান বলেছিলেন, তাদেরকেও চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছেন ট্রাইব্যুনালের তদন্ত টিম।

এদিকে শেখ হাসিনার নির্দেশে বিভিন্ন ব্যক্তি ও রাজনৈতিক নেতাকে গুম এবং অপহরণের সংশ্লিষ্টতা পেয়েছে গুম তদন্ত কমিশন।

গুম তদন্ত কমিশন সূত্র জানায়, শেখ হাসিনার নির্দেশেই ইলিয়াস আলীকে গুম এবং খুন করা হয়েছিল। শেখ হাসিনা সরকারের সময়ে এসএসএফ-এর মহাপরিচালক ছিলেন লে. জেনারেল চৌধুরী হাসান সওরাওয়ার্দী। তার সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, ডিজিএফআইর তৎকালীন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ডেকে নিয়ে ইলিয়াস আলীকে গুম করার নির্দেশ দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। পরবর্তী সময়ে ইলিয়াস আলীর স্ত্রীকে ডেকে এনে নাটকও করেছিলেন।

পুরাতন শাড়ি পরে জড়িয়ে ধরেছিলেন ইলিয়াস আলীর স্ত্রী ও কন্যাকে। এ সময় ইলিয়াস আলীর স্ত্রীকে শেখ হাসিনা জানিয়েছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার নির্দেশে অপহরণ করা হয়েছে। অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিরোধের জের হিসেবে এটা করা হয়েছে বলে ইলিয়াস আলীর স্ত্রীকে অবহিত করেছিলেন শেখ হাসিনা।

এদিকে গুম কমিশনের প্রাথমিক রিপোর্টেও উল্লেখ করা হয়েছে অনেক গুমের ঘটনা শেখ হাসিনার নির্দেশে হয়েছিল। এই বিষয়ে ডিজিএফআই’র সাবেক একাধিক মহাপরিচালক গুম কমিশনের জিজ্ঞাসাবাদেও এ কথা স্বীকার করেছেন।

 

guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

এই বিভাগের আরও খবর

ট্রাফিকে ১ হাজার ছাত্রকে নিয়োগের প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী জানিয়েছেন, ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেওয়াদের মধ্য থেকে এক হাজার জনকে ট্রাফিকে নিয়োগ দেওয়ার ব্যাপারে প্রস্তাব পাঠানো

শেখ রেহানার ছেলে-মেয়ে ‘মিথ্যা প্রোপাগান্ডা’ ছড়ানো গোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িত

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের অবকাঠামো প্রকল্প থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগের তদন্তে নাম এসেছে শেখ হাসিনার বোন

গাজায় শান্তি প্রতিষ্ঠায় অনড় তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজায় শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রতি অটল প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন, আমরা ফলাফল (গাজায় শান্তি প্রতিষ্ঠা) না পাওয়া পর্যন্ত

ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় তীব্র গ্যাস সংকট

রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় তীব্র গ্যাসের সংকট চলছে। দিনের বেশিরভাগ সময়ে গ্যাস না থাকায় নগরবাসী চরম ভোগান্তিতে সময় পার করছেন। কিন্তু গত কয়েকদিন যাবত লাইনে

Scroll to Top