জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ানঃ
ইতিহাসের বুকে লাল রক্তের আঁচড়ে লেখা এক অবিস্মরণীয় দিন, বাঙালির চেতনায় শেকড় গেড়ে বসা একুশে ফেব্রুয়ারি। ভাষার অধিকার আদায়ের তীব্র আগুনে জ্বলে উঠেছিল ঢাকার রাজপথ, যখন মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় জীবন উৎসর্গ করেছিলেন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার ও নাম না-জানা অগণিত ভাষাসৈনিক। তাদের রক্তস্রোতে উন্মোচিত হয়েছিল ভাষাচেতনার অমর মহাকাব্য।
১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ বিভাজনের পর, পাকিস্তানের নব্য শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) জনগণের ভাষা, সংস্কৃতি ও আত্মপরিচিতিকে পদদলিত করে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে। ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ যখন বললেন, “উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা”, তখনই বাংলার বুকে জ্বলে উঠল প্রতিবাদের চিরন্তন প্রদীপ।
বায়ান্নর সেই শীতল সকালে, ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে রাস্তায় নেমে আসে ছাত্র, শিক্ষক, শ্রমিক, কৃষক—সমগ্র জনতা। “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই”—এই এক বাক্যে বাঙালির চেতনার সমস্ত তীব্রতা যেন সঞ্চারিত হলো। পুলিশের নির্বিচার গুলিতে রাজপথ রঞ্জিত হলো তাজা রক্তে। মাটিতে লুটিয়ে পড়ল একেকটি জীবন, কিন্তু ম্লান হলো না ভাষার দাবির শ্বেতপতাকা।
ভাষার জন্য এমন আত্মত্যাগ বিশ্ব ইতিহাসে বিরল। শহীদদের তাজা রক্তের বিনিময়ে বাঙালি ফিরে পেল তার ভাষার অধিকার। ১৯৫৬ সালে বাংলা ভাষা পেল পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা। এই রক্তস্নাত পথ বেয়েই শুরু হলো বাঙালির স্বাধীনতার চূড়ান্ত সংগ্রাম, যার পরিণতিতে ১৯৭১ সালে প্রতিষ্ঠিত হলো স্বাধীন বাংলাদেশ।
বাঙালির এই গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস শুধু দেশেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বদরবারে। ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। আজ বিশ্বের নানান প্রান্তে, বহুভাষিক মানুষ এই দিনটিতে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে ভাষার অধিকার, বৈচিত্র্য এবং মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা।
একুশে ফেব্রুয়ারি আজ শুধু শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ নয়, এটি প্রতিটি বাঙালির আত্মপরিচয়ের ভিত্তি। প্রভাতফেরির মৃদু কণ্ঠে যখন বাজে “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি”, তখন কেবল গান নয়, সেটি যেন জাতির হৃদয়ে এক অবিনাশী স্পন্দন।
এই দিন আমাদের শেখায়, মাতৃভাষা কেবল ভাষা নয়, এটি আত্মার স্বর, সংস্কৃতির শেকড়, অস্তিত্বের প্রতিচ্ছবি। একুশের চেতনা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সত্যের পক্ষে দাঁড়াতে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সুর তুলতে, ভাষা আর সংস্কৃতির সুরক্ষায় সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত থাকতে।