২২শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৯ই ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ২৩শে শাবান, ১৪৪৬ হিজরি

মাতৃভাষা দিবস, রক্তিম অর্ঘ্যে অঙ্কিত ভাষাচেতনার অমর আলেখ্য

জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ানঃ

ইতিহাসের বুকে লাল রক্তের আঁচড়ে লেখা এক অবিস্মরণীয় দিন, বাঙালির চেতনায় শেকড় গেড়ে বসা একুশে ফেব্রুয়ারি। ভাষার অধিকার আদায়ের তীব্র আগুনে জ্বলে উঠেছিল ঢাকার রাজপথ, যখন মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় জীবন উৎসর্গ করেছিলেন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার ও নাম না-জানা অগণিত ভাষাসৈনিক। তাদের রক্তস্রোতে উন্মোচিত হয়েছিল ভাষাচেতনার অমর মহাকাব্য।

১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ বিভাজনের পর, পাকিস্তানের নব্য শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) জনগণের ভাষা, সংস্কৃতি ও আত্মপরিচিতিকে পদদলিত করে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে। ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ যখন বললেন, “উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা”, তখনই বাংলার বুকে জ্বলে উঠল প্রতিবাদের চিরন্তন প্রদীপ।

বায়ান্নর সেই শীতল সকালে, ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে রাস্তায় নেমে আসে ছাত্র, শিক্ষক, শ্রমিক, কৃষক—সমগ্র জনতা। “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই”—এই এক বাক্যে বাঙালির চেতনার সমস্ত তীব্রতা যেন সঞ্চারিত হলো। পুলিশের নির্বিচার গুলিতে রাজপথ রঞ্জিত হলো তাজা রক্তে। মাটিতে লুটিয়ে পড়ল একেকটি জীবন, কিন্তু ম্লান হলো না ভাষার দাবির শ্বেতপতাকা।

ভাষার জন্য এমন আত্মত্যাগ বিশ্ব ইতিহাসে বিরল। শহীদদের তাজা রক্তের বিনিময়ে বাঙালি ফিরে পেল তার ভাষার অধিকার। ১৯৫৬ সালে বাংলা ভাষা পেল পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা। এই রক্তস্নাত পথ বেয়েই শুরু হলো বাঙালির স্বাধীনতার চূড়ান্ত সংগ্রাম, যার পরিণতিতে ১৯৭১ সালে প্রতিষ্ঠিত হলো স্বাধীন বাংলাদেশ।

বাঙালির এই গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস শুধু দেশেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বদরবারে। ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। আজ বিশ্বের নানান প্রান্তে, বহুভাষিক মানুষ এই দিনটিতে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে ভাষার অধিকার, বৈচিত্র্য এবং মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা।

একুশে ফেব্রুয়ারি আজ শুধু শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ নয়, এটি প্রতিটি বাঙালির আত্মপরিচয়ের ভিত্তি। প্রভাতফেরির মৃদু কণ্ঠে যখন বাজে “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি”, তখন কেবল গান নয়, সেটি যেন জাতির হৃদয়ে এক অবিনাশী স্পন্দন।

এই দিন আমাদের শেখায়, মাতৃভাষা কেবল ভাষা নয়, এটি আত্মার স্বর, সংস্কৃতির শেকড়, অস্তিত্বের প্রতিচ্ছবি। একুশের চেতনা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সত্যের পক্ষে দাঁড়াতে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সুর তুলতে, ভাষা আর সংস্কৃতির সুরক্ষায় সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত থাকতে।

guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

এই বিভাগের আরও খবর

ক্যামেরায় স্বপ্ন বুনছেন নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রাবণ

ইকবাল মাহমুদ, নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিঃ  ইশতিয়াক আহমেদ শ্রাবণ ২০১৯ সালে ফটোগ্রাফির জগতে প্রবেশ করেন। একটি অ্যান্ড্রয়েড ফোন দিয়ে তার যাত্রা শুরু। তখনো ফটোগ্রাফির গভীরতা বা

প্রেমিককে ভিডিও কলে রেখে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীর আত্মহত্যার চেষ্টা

ইকবাল মাহমুদ, ক্যাম্পাস প্রতিনিধি, নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ঃ প্রেমিককে ভিডিও কলে রেখে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাককানইবি) এক ছাত্রী। গতকাল মঙ্গলবার (১৮

হারানো বিজ্ঞপ্তি

আমি : মো: সালমান হোসেন, পিতা: মো: মিয়া হোসেন, মাতা: মিনা আক্তার, জাতীয় পরিচয় পত্র নম্বর: ৮২৫১০২২৭১৪ স্হায়ী ঠিকানা: গ্রাম: পাড়াদূর্গাপুর, ডাকঘর: আশুজিয়া, উপজেলা: কেন্দুয়া,

মেহেরপুরে ষাটোর্ধ প্রবীনদের মিলনমেলা

কে এম হাসান মেহেরপুর প্রতিনিধি: মেহেরপুরে চকশ্যামনগরে ষাটোর্ধদের নিয়ে নানা আয়োজনে হয়ে গেলো ” প্রবীনদের মিলনমেলা। মেহেরপুর সদর উপজেলার চকশ্যামনগর গ্রামের প্রবাসী ও গ্রামবাসীর আয়োজনে

Scroll to Top