জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ানঃ
রোজার প্রথম প্রহর। কক্সবাজারে জুম কাটার আকাশে ফজরের আলো ফোটার ঠিক আগে মসজিদের মাইকে সেহরির শেষ সময়ের ঘোষণা শোনা গেল। গ্রামজুড়ে তখন ব্যস্ততা, সবার ঘরে সেহরির আয়োজন চলছে। কারও ঘরে দুধ-রুটি, কারও পোলাও-মাংস, কারও বা নরম গরম রুটি আর ঘন ডাল।
কিন্তু আব্দুল্লাহর ঘরে এসব কিছুই নেই। মাত্র এক মুঠো মুড়ি আর শুকনো খেজুরের কয়েকটি টুকরো নিয়ে মা ও ছেলে একসঙ্গে বসে আছে। মা চোখ মুছলেন। ছেলেকে কষ্ট দিতে চান না, কিন্তু তার বুকের ভেতরটা হাহাকার করে উঠল।
আব্দুল্লাহ মায়ের হাত ধরে হেসে বলল,
“মা, আমাদের খাবার একটু কম, কিন্তু রোজাটা তো আসলেই ধৈর্যের পরীক্ষা। আমরা ঠিক জিতব, দেখো!”
সে জানে, এই ক্ষুধা শুধু তার একার নয়। আশপাশের আরও অনেক ঘরে আজ ঠিক এই চিত্র। শুধু তাদের কোনো কণ্ঠ নেই, শুধু তাদের কষ্ট কেউ দেখে না।
সূর্য মাথার ওপরে উঠতেই গরমে বাতাস ভারী হয়ে আসে। আব্দুল্লাহর ঠোঁট ফেটে চৌচির, তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে কাঠ। তবুও সে ক্লাসে যায়, লেখাপড়া করে, মুখে হাসি ধরে রাখে। তার বন্ধুরা কেউ লুকিয়ে পানি খায়, কেউ মাদ্রাসার পাশে লুকিয়ে বিস্কুট খায়। কেউ আবার এসে কানে কানে বলে,
“এত কষ্ট করছ কেন? রোজা ভেঙে ফেলো না হয়!”
কিন্তু আব্দুল্লাহ মৃদু হেসে বলে, “আল্লাহ আমাদের পরীক্ষা নিচ্ছেন। পরীক্ষায় তো পাশ করতেই হবে, তাই না?”
বিকেল গড়াতে থাকে। মাঠে খেলতে যায় না সে, বরং দৌড়ে হাজী ইসমাইল সাহেবের মুদি দোকানে যায়। কাজ শেষে সামান্য কিছু টাকা হাতে আসে। সে দ্রুত বাজারে গিয়ে কিনে নেয় সামান্য মুড়ি, কয়েকটা খেজুর আর একটু সস্তা সেমাই। এ যেন তার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পাওয়া!
মা খাবারগুলো দেখে আবেগে চোখের জল ফেললেন। কিন্তু মুখে হাসি টেনে বললেন,
“আল্লাহ আমাদের দেখছেন, বাবা! তিনি কখনো আমাদের ফেলে রাখবেন না।”
সন্ধ্যা নামে। আকাশে রঙিন আলো মিশে যায়। বাতাসে আজানের সুমধুর ধ্বনি ভেসে আসে। আব্দুল্লাহ মায়ের পাশে বসে ইফতার শুরু করে। খেজুরের ছোট্ট টুকরো মুখে দিয়ে মনে হলো, এটাই যেন জান্নাতের শ্রেষ্ঠ খাবার!
ঠিক তখনই দরজায় শব্দ হলো। বাইরে হাজী ইসমাইল সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন, হাতে বড় খাবারের থলে আর কিছু টাকা। আব্দুল্লাহ বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে।
“বাবা, তোমার ধৈর্য, তোমার ইমান আমাকে মুগ্ধ করেছে। এই মাস রহমতের, এই মাস দানের। আমি এসেছি তোমাদের জন্য আল্লাহর রহমত নিয়ে!”
আব্দুল্লাহর চোখে পানি এসে গেল। এতদিন শুধু শুনেছে, আল্লাহ ধৈর্যশীলদের ভালোবাসেন। আজ সে তা নিজের চোখে দেখল।
রাত গভীর হলে আব্দুল্লাহ মায়ের পাশে শুয়ে বলল,
“মা, আমি বড় হয়ে এমন একজন হবো, যে গরিবদের অভুক্ত থাকতে দেবে না।”
মা কেঁদে ফেলে, কিন্তু সে কান্না বেদনার নয়, বরং তৃপ্তির। আজ তার ছেলে সত্যিকারের রমজানের শিক্ষা পেয়েছে।
📢 আহ্বান: অসহায়দের কথা ভাবুন!
বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে এমন হাজারো আব্দুল্লাহ আছে, যারা একমুঠো মুড়ি আর এক ফোঁটা পানির অভাবে কষ্ট নিয়ে রোজা রাখছে। কত মা রাতের আঁধারে চোখের জল ফেলছেন, কারণ সন্তানের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার ক্ষমতা তাদের নেই।
যারা সচ্ছল, যাদের ঘরে ইফতারে নানা আয়োজন, তাদের কি একবারও মনে হয় না—পাশের ঘরে কেউ না খেয়ে আছে?
রমজান ধৈর্য ও আত্মশুদ্ধির মাস, কিন্তু এ মাস দানেরও মাস। এ মাসে এক টুকরো রুটি, এক মুঠো চাল, এক বোতল পানি কারও জন্য হতে পারে বেঁচে থাকার উৎস।
যারা সচ্ছল, তারা এগিয়ে আসুন। আপনার দান হয়তো কোনো এক ক্ষুধার্ত শিশুর মুখে হাসি এনে দিতে পারে, কোনো মায়ের চোখের জল মুছে দিতে পারে।
রমজান মানে শুধু নিজের জন্য ইবাদত নয়—রমজান মানে অন্যের কষ্ট ভাগ করে নেওয়া, অসহায়দের পাশে দাঁড়ানো।
“আসুন, আমরা আমাদের রমজান পূর্ণতা দেই—অন্যের জন্য কিছু করে!”
লেখক, শিক্ষার্থী, আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়, কায়রো, মিশর