রাজবাড়ী প্রতিনিধিঃ
সামনে-পিছনে মোটরসাইকেল বহর, মাঝে দামি প্রাইভেটকার বা জীপ। এভাবেই যাচ্ছেন নেতা। মেয়ের বিয়ে, সভা-সমাবেশ, খেলাধুলা, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অনুদান দিয়ে অল্পদিনেই দানবীর হিসেবে এলাকার মানুষের মনে দানবীর হিসেবে জায়গা করে নেন। জেলা পরিষদের হিসাব রক্ষকের চাকুরী ছেড়ে উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী হতে আওয়ামী লীগের এমপি সহ নেতাদের আস্থা ভাজন হয়ে ওঠেন। এলাকার অলিগলিতে পোস্টার, লিফলেট, বিলবোর্ড টাঙান। অবশেষে তার আর সেই স্বপ্নপুরণ হয়নি। এটা আসলে কোন সিনেমার ডায়ালং নয়, বলছিলাম কিশোরগঞ্জ জেলা পরিষদের হিসাব রক্ষক মোঃ আবুল কালাম আজাদের কথা। তিনি রাজবাড়ীতে এভাবেই চলাচল করেন। নামে-বেনামে গড়ে তুলেছেন শতকোটি টাকার সম্পদ। তার এ বিষয়ে অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যেকর তথ্য।
এলাকাবাসী ও বিভিন্ন সুত্রে জানা গেছে, একসময় রাজবাড়ী জেলা আওয়ামী লীগের এক প্রভাবশালী নেতার বাসা দেখাশুনার দায়িত্ব পালন করতেন মোঃ আবুল কালাম আজাদ। ওই নেতা জেলা পরিষদের প্রশাসক হওয়ার পর সেই সুবাদে ২০১৪ সালে জেলা পরিষদে হিসাব রক্ষক পদে চাকুরী পান আজাদ। চাকুরী পাওয়ার পর আর তাকে পিছনে তাকাতে হয়নি। চাকরীর এক যুগের মাথায় হঠাৎ করেই তার আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বনে যাওয়ার ঘটনায় চোখ ছানাবড়া হয়ে উঠেছে স্থানীয়দের। এ কর্মকর্তার চলাফেরা করেন দামি প্রাইভেটকারে। তার হাফ ডজন সহকারির বেতন এক থেকে দেড় লক্ষ টাকা। ড্রাইভারের বেতন ২০ হাজার টাকা। অথচ সল্প সময়ে তিনি কিভাবে গড়ে তুলেছেন এত সম্পদ তা যে রুপ কথার গল্পকেও হার মানায়।
আবুল কালাম আজাদ রাজবাড়ীর পাংশা উপজেলার হাবাসপুর গ্রামের আঃ মজিদ মন্ডলের ছেলে ও জায়েদা বেগমের সন্তান। সেখান থেকে রাজবাড়ী জেলা সদরের বানিবহ ইউনিয়নের আটদাপুনিয়া গ্রামে এসে বাড়ী করেন। তিনি ২০১৪ সালের ২২ ডিসেম্বর আয়কর নথি ট্যাক্স জোন ময়মনসিংহের ট্যাক্স সার্কেল-১৩ (তার টিন নাম্বার ৪৮৫৭০২৫১২২১২)। আবুল কালাম আজাদ জেলা শহরের নুরু কন্টাক্টারের স্ত্রী নাহিদা পারভীন ও মেয়ে তাসলিমা পারভীনের কাছ থেকে নতুন বাজারের পাশে ৭ একর জমি ৩২ কোটি টাকা মূল্যে ক্রয় করেন। তবে জমিটি বিভিন্ন ব্যক্তির নামে রেজিষ্ট্রি করা হয়েছে। বানিবহ বাজারের নিকট ইউপি নগরে ইউনিক ল্যান্ড ডেভেলপার প্রাঃ লিঃ ও আন নাজার সোসাইটি নামে যে জায়গা রয়েছে হরিশচন্দ্র চক্রবর্তীর ছেলে সমীর কুমার চক্রবর্তীর নিকট থেকে এক লক্ষ ৩০ হাজার টাকা শতাংশ মূল্যে ২৬৪ শতাংশ জমি ক্রয় করেন। তার পাশেই হিমাদ্রী শঙ্কর চক্রবর্তীর তিন ছেলে বিপ্লব চক্রবর্তী, তপন চক্রবর্তী ও স্বপন চক্রবর্তী নিকট থেকে ২৪ শতাংশ জমি দেড় লক্ষ টাকা শতাংশ ক্রয় করে। রাজবাড়ী ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কার্যালয়ের পাশে ৮ শতাংশ জমি আবুল কালাম আজাদের নিজ নামে থাকার সাইন বোর্ড দেখা গেছে। স্ত্রী ও শ্যালকের নামে ক্রয় করেছে রাজবাড়ী শহরের ভবানীপুরের দোতালা বাড়ী সহ ১৩ শতাংশ জমি, নইমুদ্দিন বেপারী ও এশার উদ্দিন বেপারীর কাছ থেকে ১২ শতাংশ জমি বাণীবহ নিচপাড়ায় ক্রয় করেছেন। আদিল মেম্বার গংসহ ৯ জন ওয়ারিশের নিকট থেকে ৭২ শতাংশ জমি দুই কোটি ১০ লক্ষ টাকা দিয়ে ক্রয় করে ভাই ও স্ত্রীর নামে। বানিবহ বাজারের ওই জমির পুকুর ভরাট করে মার্কেট নির্মাণ করেছেন। ওই মার্কেট নির্মাণে আইনজীবি আল আমিন বাঁধা দিলেও আওয়ামী লীগের নেতাদের প্রভাবে আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্বেও বিনা বাঁধায় দখল করে মার্কেট নির্মাণ করেন। ক্রয়কৃত ভুমি ৪৫ লক্ষ টাকা দিয়ে বালি ভরাট করে জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি জাকারিয়া মোহাম্মদ রাজীব। আব্দুল সোবহান গাজীর বানিবহ বাজারের তিনতলা বিল্ডিং সহ ৪২ শতাংশ জমি তিন কোটি ২০ লক্ষ টাকায় কিনেছে। পাশের পুকুরে মাটি ভরাট করতে ১২ লক্ষ টাকা খরচ করেছে। কিশোরগঞ্জ জেলা পরিষদের হিসাব রক্ষক আবুল কালাম আজাদকে রাজবাড়ী জেলা শহরের বাণীবহ গ্রামের জমিদার অভিহিত করা হয়। রাজবাড়ী জেলা সদরের বানিবহ ইউনিয়নের আটদাপুনিয়া গ্রামের নিজেদের ভাঙা টিনের ঘরের পাশেই প্রায় কোটি টাকায় ৮০শতাংশ জায়গা কিনেছেন। সেখান থেকে অল্প একটু শহরের দিকে এগুলেই বাণীবহ বাজার। রাজবাড়ী জেলা শহরের শ্রীপুর বাজার থেকে সমনে কামালদিয়া ব্রিজের আগে প্রায় ৮০ শতাংশ জায়গার উপরে গড়ে তুলেছেন আর এস অটো রাইস নামে একটি ফ্যাক্টরি। যাতে তার স্ত্রী আকলিমা খাতুন ও বোন রোকেয়া বেগমের মালিকানায় রয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। রাজবাড়ী জেলা শহরের ফায়ার সার্ভিস অফিসের পাশে ও কামনা বিল্ডিংয়ের আগে রয়েছে ১২ কোটি টাকা মূল্যের ৮.৬৪ শতংশ জমি। এসব জমির বেশির ভাগই নামে বেনামে ক্রয় করেছে। তবে এ জমি ক্রয় করে কয়েকজন মিলে ব্যবসা করেন বলেও প্রকাশ করে থাকেন। বিভিন্ন ব্যাংকে এফডিআর কয়েক কোটি টাকা। স্ত্রী-সন্তান ও আত্বীয়-স্বজন, বন্ধুদের নামে বেনামে কমবেশী ৫০ বিঘা জমি ক্রয় করেছেন আবুল কালাম আজাদ। তার বিরুদ্ধে বৈষম্য বিরোধী শিক্ষার্থী হত্যার দায়ে মামলা দায়ের হয়েছে। মামলার পরও প্রকাশ্যে এলাকায় ঘুরছে।
বানিবহের গৌরাঙ্গ চক্রবর্তী বলেন, আমার পরিবারের অন্যান্য শরীকদের জমি আবুল কালাম আজাদ ক্রয় করেছেন। এখন তাদের জমি বুঝে দিতে বাড়ী-ঘর ভেঙ্গে সরানো হচ্ছে। কি আর করবো, এখন তো নিরুপায়। ঝামেলা থেকে রেহাই পেতে আমার জমির অংশ এক পাশে করে নিয়েছি।
আবুল কালাম আজাদের আপন বড় বোন ও দাদশী ইউনিয়নের গোপিনাথদিয়া আরএএস অটো ফুড প্রোডাক্টস (প্রাঃ) লিমিেিটডের পরিচালক মোছাঃ রোকেয়া বেগমের দাবী তিনি রাজবাড়ী জেলার পাংশা উপজেলার হাবাসপুর ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত নারী আসনের সদস্য। তিনি নিয়মিত আয়কর প্রদান করে। তার পিতা আঃ মজিদ মন্ডল রাজবাড়ীর পাংশা উপজেলার হাবাসপুর ইউনিয়ন পরিষদের ২ মেয়াদে নির্বাচিত ইউপি সদস্য ছিলেন। আবুল কালাম আজাদ সহ পরিবারের ৫ ভাই-বোন। তার পিতার মৃত্যুর পর মাতা মোছাঃ জায়দা বেগম পুরো পরিবারকে এক সাথে আগলে রয়েছেন। আবুল কালামের ভাই মোঃ জিয়াউর রহমান রাজবাড়ী সদর উপজেলার বানীবহ ইউনিয়নের সাবেক ইউপি সদস্য, অপর ভাই মিন্টু মন্ডল সরকারী চাকুরীজীবী, আবুল কালাম আজাদ জেলা পরিষদে চাকুরী করে এবং মিলন মন্ডল প্রাইভেট ব্যবসা পরিচালনা করে আসছে।
মোছাঃ রোকেয়া বেগমের দাবী তার ভাই আবুল কালাম আজাদ বিভিন্ন সময়ে এলাকার অসহায় ও দুঃস্থ মানুষের মধ্যে ব্যক্তিগতভাবে আর্থিক সহায়তা প্রদান করে স্থানীয়ভাবে প্রশংসা অর্জন করেছেন।
এ বিষয়ে কিশোরগঞ্জ জেলা পরিষদের হিসাব রক্ষক আবুল কালাম আজাদের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ ও ক্ষুদে বার্তা দেওয়া হলেও তিনি কোন সদুত্তর দেননি। পরে এক সংবাদকর্মীর মুঠোফোন দিয়ে কথা হয় আবুল কালাম আজাদের। তিনি বলেন, আসলে আমার অল্প কিছু জমি রয়েছে। আমি পার্টনারের সাথে জমির ব্যবসা করি। এ কারণে ওই জমিগুলো তাদের সাথে ক্রয় করা। তবে অল্প দিনেই এতো সম্পদের মালিক কিভাবে তা জানতে চাইলে সরাসরি কথা বলতে চান। পরে একাধিকবার মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।