লেখক জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ান, লেখক,শিক্ষার্থী, আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়, কায়রো, মিশর
রমজান, মুসলিম উম্মাহর সবচেয়ে পবিত্র ও মহিমান্বিত মাস, যখন প্রতিটি মুহূর্তে আল্লাহর রহমত ও বরকতের ঘর উন্মুক্ত থাকে। এটি শুধুমাত্র রোজা রাখার মাস নয়, বরং একটি আধ্যাত্মিক যাত্রা, যেখানে মুসলমানরা আত্মশুদ্ধি, ঈমানের দৃঢ়তা এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য প্রতিটি পদক্ষেপে নিজেকে পরীক্ষা করে। এক মাস ধরে রোজা রাখা, তারাবি নামাজ পড়া, কুরআন তিলাওয়াত করা, গরিব-দুঃখীদের সাহায্য করা—এসব কিছু এক অমূল্য আধ্যাত্মিক সাধনা, যা মানুষের জীবনকে আলোকিত করে।
রমজান মাসের বিদায়ের শোক এবং ঈদ-উল-ফিতরের আনন্দের মাঝে এক মিশ্র অনুভূতি সৃষ্টি হয়। একদিকে, রমজান মাসের ঐশী প্রশান্তি ও পবিত্রতা চলে যাওয়ার দুঃখ—অপরদিকে ঈদের খুশি, আল্লাহর রহমত ও নতুন জীবনের উচ্ছ্বাস। এই দুটি অনুভূতি একে অপরকে ছাপিয়ে যায়, কারণ রমজান ছিল সেই সময় যখন মুসলমানরা নিজেকে পরিশুদ্ধ করতে এবং আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিল।
কুরআন ও হাদিসে রমজান মাসের মহিমা
কুরআনে আল্লাহ তাআলা রমজান মাসের বিশেষত্ব তুলে ধরে বলেন:
“রমজান মাস, যাতে কুরআন নাযিল হয়েছে, যা মানুষের জন্য হেদায়াত ও সুস্পষ্ট দিশারী এবং সত্য-মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য নির্দেশক।” (সুরা আল-বাকারা, ২:১৮৫)
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন যে রমজান কেবল রোজা রাখার মাস নয়, বরং এটি সেই মাস, যখন কুরআন পৃথিবীতে নাযিল হয়ে মানবজাতির জন্য পথপ্রদর্শক হিসেবে দাঁড়িয়ে। কুরআন মানবতার জন্য সত্যের বার্তা, যা আমাদের জীবনের সব দিককে আলোকিত করে এবং অন্ধকার থেকে আলোর দিকে পরিচালিত করে।
রাসূলুল্লাহ সা. রমজান মাসের বিদায়ে এক বিশেষ দোয়া পাঠ করতেন, যা তাঁর হৃদয়ে রমজানের শেষ মুহূর্তের শোক প্রকাশ করত। তিনি বলেছেন,
“যে ব্যক্তি রমজান মাসে ঈমানের সাথে এবং সওয়াবের আশা করে রোজা রাখে, তার পূর্ববর্তী সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়।” (বুখারি, হাদিস নং ৩৮, মুসলিম, হাদিস নং ৭৬০)
এটি আমাদের জন্য একটি চিরকালীন উপদেশ, যেখানে রোজা রাখার মাধ্যমে আমরা শুধু ক্ষুধা ও তৃষ্ণার ত্যাগ করি না, বরং আমাদের সমস্ত পাপও মাফ হয়ে যায়। রমজান আমাদেরকে পরিশুদ্ধির পথে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ দেয় এবং আল্লাহর অশেষ রহমত লাভের সময় এনে দেয়।
ঈদ, রমজান মাসের পরিপূর্ণতার প্রতীক
রমজান মাসে অর্জিত আধ্যাত্মিক প্রশান্তি, ত্যাগ এবং ঈমান ঈদের দিন এসে পূর্ণতা লাভ করে। ঈদ কেবল একটি আনন্দের উৎসব নয়, বরং এটি আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের একটি সোনালী মুহূর্ত। ঈদ আসে এমন একটি দিন হিসেবে, যখন আমরা একত্রিত হয়ে আল্লাহর রহমত ও দয়ার জন্য তাঁকে ধন্যবাদ জানাই এবং একে অপরকে ক্ষমা করে শান্তির বার্তা পাঠাই। রাসূল সা.বলেছেন:
“তোমাদের রমজান মাসের রোজা ও তারাবি নামাজ আল্লাহ তাআলার কাছে একমাত্র প্রাপ্তির মাধ্যম। আর ঈদের দিন আল্লাহ তাদের জন্য পুরস্কার দেন।” (আত-তাবারানি, হাদিস নং ৪০৩৬)
এটি একটি চমৎকার স্মরণ, যেখানে ঈদ আমাদের জীবনের পরিশুদ্ধির ফলস্বরূপ প্রাপ্ত শান্তি ও আল্লাহর কাছ থেকে প্রাপ্ত উপহারকে উদযাপন করার একটি বিশেষ দিন হয়ে ওঠে।
রমজান মাসের শিক্ষা, সারাবছর ধরে পালনীয় দীক্ষা
রমজান মাস চলে গেলেও, তার শিক্ষা আমাদের জীবনে চিরকালীন প্রভাব রেখে যায়। আমরা শিখেছি কিভাবে নিজেদের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করতে হয়, কিভাবে আল্লাহর প্রতি আনুগত্য ও ভালোবাসা বাড়িয়ে নিজেদের জীবনকে সুন্দর ও অর্থপূর্ণ করতে হয়। রমজান মাসে আমরা যে পরিমাণ ধৈর্য, ত্যাগ এবং সহানুভূতির শিক্ষা পাই, তা আমাদের সারাবছর ধরে পালিত হওয়া উচিত। এই মাস আমাদের শিখিয়েছে যে, আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও ভালোবাসার মাধ্যমে যে কোনো বাধা অতিক্রম করা সম্ভব এবং সত্যিকারের শান্তি এবং সুখ লাভ করা যায়।
রমজান মাসের বিদায়ের শোকের মাঝে, ঈদ আমাদের জীবনে আল্লাহর রহমত ও প্রশান্তি নিয়ে আসে, যেন আমরা নিজেরা আল্লাহর দয়ার ছায়ায় চলতে পারি এবং সারা বছর ধরে নিজের ঈমান ও কর্মে পরিশুদ্ধ হতে পারি। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে রমজান মাসের শিক্ষা হৃদয়ে ধারণ করতে এবং তা জীবনে বাস্তবায়ন করতে সাহায্য করুন।