জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ান, আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়, কায়রো, মিশর
কায়রোর প্রাচীন হৃদয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি বর্ণময় আলোকস্তম্ভ— আল-আজহার। হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে জ্ঞান, আধ্যাত্মিকতা ও মানবিকতার বার্তা ছড়িয়ে আসা এই প্রতিষ্ঠান কেবল মিসরের গর্ব নয়, মুসলিম বিশ্বের বিবেকও বটে। এই আলো-প্রাসাদের মিম্বর থেকে যখন কোনো শব্দ উচ্চারিত হয়, তা শুধু ধর্মীয় উপদেশ হয়ে থাকে না, হয়ে ওঠে চেতনার মশাল, সত্যের প্রত্যয়।
গত শুক্রবার, ঐতিহাসিক আল-আজহার মসজিদের মিম্বর থেকে যে খুতবা উচ্চারিত হলো, তা সময়ের প্রয়োজনে ছিল অদ্ভুতরকম প্রাসঙ্গিক। খুতবা প্রদান করেন অধ্যাপক ড. আব্দুল ফাত্তাহ আল-আওয়ারী, যিনি আল-আজহারের উসূলুদ্দীন অনুষদের সাবেক ডিন এবং একজন খ্যাতিমান ইসলামি চিন্তাবিদ। তিনি বলেন, দেশপ্রেম কোনো বাহ্যিক চর্চা নয়, এটি মানুষের হৃদয়ে জন্ম নেওয়া এক গভীর অনুভব। জন্মভূমির প্রতি ভালোবাসা ঈমানেরই অংশ— এমনটাই আমাদের শিক্ষা দেয় ইসলাম।
তিনি তুলে ধরেন, প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সেই হৃদয়ভাঙা মুহূর্ত, যখন তাঁকে মক্কা ত্যাগ করতে হয়েছিল। প্রিয় শহরের দিকে ফিরে চোখে জল নিয়ে নবীজি বলেছিলেন— “তুমি আমার কাছে দুনিয়ার সবচেয়ে প্রিয় স্থান, যদি না তোমার বাসিন্দারা আমাকে বের করে দিত, আমি কখনোই তোমাকে ছেড়ে যেতাম না।” এই অনুভব কোনো সাধারণ ভালোবাসা নয়— এটি শিকড়ের টান, মাটির সঙ্গে আত্মার সংলাপ। তখনই আল্লাহ তাঁকে আশ্বাস দেন: “নিশ্চয়ই, যিনি তোমার ওপর কুরআন নাজিল করেছেন, তিনিই তোমাকে তোমার ঠিকানায় ফিরিয়ে দেবেন।” (সূরা কাসাস: ৮৫)
এই আয়াত শুধু সান্ত্বনার নয়, এটি বিজয়ের পূর্বাভাস। কিন্তু নবীজি যখন ফিরলেন, সেটা প্রতিশোধ নিয়ে নয়, বরং ক্ষমার আলো ছড়িয়ে। তিনি তাঁর শত্রুদেরও মাফ করে দিলেন। এমন উদারতা, এমন হৃদয়ের বিশালতা, কেবল একজন নবীর পক্ষেই সম্ভব।
ড. আওয়ারী বলেন, আজকের মুসলিম উম্মাহ গভীর বিভক্তির মাঝে রয়েছে। মতভেদ, দলাদলি, বিভেদ— এসব আমাদের ভিত নড়বড়ে করে দিয়েছে। অথচ কুরআন স্পষ্টভাবে নির্দেশ দিয়েছে: “তোমরা সবাই আল্লাহর রজ্জু দৃঢ়ভাবে ধারণ করো এবং বিভক্ত হয়ো না।” (সূরা আল ইমরান: ১০৩) আরও বলা হয়েছে: “তোমরা বিবাদে লিপ্ত হয়ো না, তা না হলে তোমরা দুর্বল হবে, তোমাদের শক্তি ক্ষয় হবে।” (সূরা আনফাল: ৪৬) এই সব আয়াত যেন আজকের বাস্তবতায় আয়না হয়ে দাঁড়ায়। বাইরের শত্রুর প্রয়োজনই পড়ে না— আমরা নিজেরাই নিজেদের দুর্বল করছি।
এই খুতবার সবচেয়ে মর্মস্পর্শী অংশ ছিল ফিলিস্তিন প্রসঙ্গে। গাজা আজ এক দগদগে ঘা, এক জীবন্ত কান্না। শিশুদের আর্তনাদ, ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়া মা-বাবার আহাজারি— এসবের মাঝে বিশ্ব আজ নির্বিকার। ড. আওয়ারী বলেন, যারা মানবতা ও স্বাধীনতার বুলি কপচায়, তাদের মুখোশ খুলে গেছে। মুসলমানদের ভূমি কখনো অন্য কারও হতে পারে না— এই ঘোষণা কেবল একটি রাজনৈতিক বক্তব্য নয়, এটি আত্মপরিচয়ের সীমানা টেনে দেওয়া এক দুর্বার ঘোষণা।
এই খুতবা কেবল একটি বক্তব্য ছিল না— ছিল এক জাগরণ, এক সতর্ক সংকেত। তিনি বললেন, এখন সময় ঘুম ভাঙানোর, আত্মচেতনায় ফিরে আসার। আমাদের শত্রুরা আমাদের বিশ্বাস, মূল্যবোধ, সভ্যতা— সবকিছুকে তুচ্ছ করে দেখছে। এই পরিস্থিতিতে দরকার ঐক্য, পরস্পরের প্রতি সহনশীলতা, নিজের অবস্থান ও অস্তিত্ব রক্ষার অঙ্গীকার।
আল-আজহারের পবিত্র মিম্বর থেকে উচ্চারিত এই খুতবা যেন এক বজ্রনিনাদ, যা ঘুমন্ত চেতনাকে জাগিয়ে তোলে। এটি যেন আমাদের মনে করিয়ে দেয়, এই পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তেই হোক— মাটির টান, ধর্মের শেকড়, ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার— এগুলো কোনোদিনও কুক্ষিগত করার নয়। এগুলো রক্ষা করতে হয় ভালোবাসা দিয়ে, একতা দিয়ে, আর প্রয়োজনে, জীবন দিয়েও।