শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার প্রায় তিন মাস পর শেখ হাসিনার লিখিত পদত্যাগপত্র না পাওয়ার কথা বললে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল সোমবার রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে শপথ ভঙ্গের অভিযোগ করেন৷ অন্তর্বর্তী সরকারের সমর্থক ছাত্ররা এরই মধ্যে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনকে ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ বলে তার পদত্যাগ দাবি করেছে৷ এই দাবিতে মঙ্গলবার বিকালে তারা শহিদ মিনারে সমাবেশ ও বঙ্গভবন ঘেরাওয়ের চেষ্টা করে৷ তারা রাষ্ট্রপতিকে পদ ছাড়তে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়েছে৷ এর মধ্যে পদত্যাগ না করলে তারা বঙ্গভবন ঘেরাওসহ আন্দোলন গড়ে তুলবে বলে জানিয়েছে৷
সংবিধানের ৫৭ (ক) ধারা অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করলে রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিতে হয়৷ এতদিন প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করে দেশ ছেড়েছেন বলেই ধারণা করা হয়েছে৷ ৫ আগস্ট জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে রাষ্ট্রপতি ও সেনাপ্রধানও জানিয়েছিলেন শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়েছেন৷ তাই এ নিয়ে বিতর্কের কোনো অবকাশ নেই৷
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, ‘এখন স্পিকার নাই, ডেপুটি স্পিকার নাই৷ ফলে রাষ্ট্রপতি কার কাছে পদত্যাগ করবেন৷ এখানে একটা শূণ্যতা আছে৷ এইক্ষেত্রে একমাত্র পথ হলো ডকট্রিন অব নেসেসিটি৷ নেসেটিটি এটাকে লিগ্যাল করে৷ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মামলার যে রায় আছে সেখানে এই কথাই বলা হয়েছে৷ আর তাকে অভিসংশনের কোনো সুযোগ নাই৷ যেহেতু পার্লামেন্ট নাই৷ পার্লামেন্ট ছাড়া তো আর অভিসংশন হবে না৷’
শেখ হাসিনার পদত্যাগ বিতর্ক নিয়ে তিনি বলেন, ‘এটা নিয়ে আসলে বিতর্কের কোনো অবকাশ নেই৷ সুপ্রিম কোর্টের রেফারেন্সে তার পদত্যাগের কথা বলা হয়েছে৷ রাষ্ট্রপতি তার ভাষণে বলেছেন৷ আবার সোমবার বঙ্গভবন একটি প্রেসনোট দিয়েছে৷’
সুপ্রিম কোর্টের আরেক আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ‘শেখ হাসিনা দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার মাধ্যমেই পদত্যাগ করেছেন৷ তিনি তার কাজের মাধ্যমেই প্রমাণ করেছেন যে তিনি আর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নন৷ ফলে তিনি পদত্যাগ করেছেন কি করেন নাই সেই বিতর্ক খুবই অপ্রাসঙ্গিক৷’
‘তবে সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগে জটিলতা আছে৷ কারণ, সংবিধান অনুযায়ী সংসদ সদস্যরা তাকে নিয়োগ দিয়েছেন৷ এখন তার নিয়োগকারী সংসদই তো নাই৷ এখন তিনি তার পদত্যাগপত্র কোথায় পাঠাবেন? তার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করার কোনো কর্তৃপক্ষ নাই৷ আবার অন্তর্বর্তী সরকার, যাদের তিনি নিয়োগ দিয়েছেন, তারা কীভাবে তার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করবেন,’ বলেন তিনি৷
তার কথা, ‘তবে এখন তিনি পদত্যাগ করবেন কি করবেন না এটা রাজনৈতিক প্রশ্ন৷ যেহেতু সংবিধানে সুযোগ নাই৷ তাই রাজনৈকি দলসহ সবার ঐক্যমতের ভিত্তিতে এটা হতে পারে৷ পরের সংসদ এসে এর বৈধতা দেবে৷’
তবে ব্যারিস্টার মাহবুব শফিক বলেন, ‘যেহেতু সংবিধান বহাল আছে তাই সংসদ ছাড়া তার পদত্যাগ অথবা অভিসংশন সম্ভব নয়৷ স্পিকার পদত্যাগ করেছেন৷ ডেপুটি স্পিকার কারাগারে৷ সংসদ নাই৷ তাকে যদি অন্যকোনো প্রক্রিয়ায় সরানো হয় তাহলে সাংবিধানিক শূন্যতা তৈরি হবে৷’
‘আমার মতে এরইমধ্যে এক ধরনের সাংবিধানিক শূন্যতা তৈরি হয়েছে৷ কারণ যে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছে৷ রাষ্ট্রপতির কাছে শপথ নিয়েছে৷ তারা সাংবিধানিক নয়৷ সংবিধানে এধরনের সরকার নাই৷ আর শেখ হাসিনা যদি প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে থাকেন তিনি যদি চলে গিয়ে থাকেন তাহলে সংবিধান অনুযায়ী কারা দায়িত্ব নেবেন তা কিন্তু সংবিধানে আছে৷ তা অনুসরণ করা হয়নি৷’
বিএনপি রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের দাবি ও প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ বিতর্ক নিয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি৷ দলটির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, ‘এখন যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তা বিএনপি পর্যবেক্ষণ করছে৷ এটি একটি স্পর্শকাতর বিষয়৷ আমাদের দলের নীতি নির্ধারকরা পর্যবেক্ষণ শেষে আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দেবেন৷’
‘এখানে নানা মুখী ষড়যন্ত্র আছে৷ চক্রান্ত আছে৷ পতিত স্বৈরাচারের দোসর, বিদেশি গোষ্ঠী এখনো সক্রিয়৷ তারা ছাত্র জনতার বিপ্লব, গণতান্ত্রিক যাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করতে চায়৷ তাই আমাদের সতর্ক থাকতে হবে,’ বলেন তিনি৷
গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, ‘শেখ হাসিনার পদত্যাগ করা না করা এখন আর কোনো ইস্যু না৷ আর রাষ্ট্রপতি একজন সম্পাদককে যা বলেছেন তা নিয়ে বিতর্ক হয়েছিল৷ কিন্তু ওনার দপ্তর থেকে বিবৃতি দিয়ে তা আবার পরিস্কার করা হয়েছে৷ রষ্ট্রপতি যদি তার বক্তব্যে অটল থাকতেন তাহলে শপথ ভঙ্গ হতো৷’
তার কথা, ‘তবে সবাই যদি মনে করেন, একমত হন তাহলে ডকট্রিন অব নেসেসিটির জায়গা থেকে রাষ্ট্রপতিকে সরিয়ে দেয়া যেতে পারে৷ সেক্ষেত্রে প্রধান উপদেষ্টা ও রাষ্ট্রপতি একই ব্যক্তি হতে পারেন৷ যেভাবে ওয়ান ইলেভেনের আগে অধ্যাপক ইয়াজ উদ্দিন আহমেদ একই সঙ্গে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্বে ছিলেন৷’
আর বাংলাদেশের কমিউনিউস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স মনে করেন, ‘আসলে এখন শেখ হাসিনার পদত্যাগ এই বিষয়ে বিতর্কের কোনো প্রয়োজন নাই৷ রাষ্ট্রপতির পদত্যাগও কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়৷ এখন যেটা দরকার তা হলো প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলো দ্রুত শেষ করা৷ এরপর দ্রুত নির্বাচনের দিকে যাওয়া৷ আসলে নানা ধরনের প্রশ্ন তুলে এই সরকারকে মূল কাজ থেকে দূরে সরানোর চেষ্টা আছে, থাকবে৷ সেই ফাঁদে পা দেওয়া যাবে না৷ মূল কাজে মনোযোগ দিতে হবে৷’