বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী তিন বছর আগে করোনায় সংক্রমিত হয়ে মারা যান । রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ৬৮ বছর বয়সে তার মৃত্যু হয়। তৎকালীন সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তার মৃত্যুর বিষয়টি ধামাচাপা দিয়ে জোরপূর্বক সাভারের একটি মাদরাসা প্রাঙ্গণে কবর দিতে বাধ্য করে বলে অভিযোগ রয়েছে।
পরবর্তীসময়ে জানা যায়, হারিছ চৌধুরীকে ‘মাহমুদুর রহমান’ নামে সাভারে দাফন করা হয়। সরকার তার প্রকৃত পরিচয় অনুযায়ী কোনো মৃত্যুসনদ দেয়নি। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তার প্রাপ্য সম্মানটুকুও তিনি পাননি। তবে মাহমুদুর রহমানই হারিছ চৌধুরী কি না সেটা নিয়ে বিভ্রান্তি পুরোপুরি কাটেনি।
হারিছ চৌধুরীর মেয়ে সামিরা তানজিন চৌধুরী বলেন, ‘বাবা মারা গেছেন, কিন্তু বিগত সরকার এটা মেনে নেয়নি। তাহলে কি আমার বাবাকে আমি জীবিত রেখে দেবো, তা না হলে কাউকে আমার বাবাকে খুঁজে দিতে হবে। আমার বাবা তো নিরুদ্দেশ থাকতে পারেন না। কোনো ব্যক্তির মৃত্যু হলে এটার একটি সার্টিফিকেট লাগবে। তিনি তো যেমন-তেমন মানুষ ছিলেন না। তার মৃত্যুর বিষয়টা তো প্রমাণিত হতে হবে। যে কোনো যেমন-তেমন মানুষেরও মানবিক অধিকার থাকে। আমার বাবার মানবিক অধিকার রক্ষা হয়নি।’
ওই সময় হারিছ চৌধুরীর মরদেহকে অন্য পরিচয়ে কেন দাফন করা হয়েছিল প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘বাবার মরদেহ আমার দাদুর বাড়িতে নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। আমি দেখলাম গণমাধ্যম অহরহ রিপোর্ট করছে মাহমুদুর রহমান নামে হারিছ চৌধুরীর দাফন। এটা আসলে সঠিক নয়। আমার প্রশ্ন, কে মাহমুদুর রহমান নামে দাফন করেছে?’
আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর ক্ষোভ ঝেড়ে হারিছ চৌধুরীর মেয়ে বলেন, ‘আগের সরকারের হিংসার পাত্র ছিল আমার বাবা। তখনকার সময়ে বিরোধীদলীয় নেতাদের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসামূলক মামলা হয়েছে। আমার বাবা গত সরকারের আমলে নির্যাতিত হওয়াদের মধ্যে অন্যতম একজন। এ কারণে তিনি আত্মগোপনে ছিলেন, কিন্তু দেশ ছেড়ে যাননি।’
ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর হারিছ চৌধুরীর মেয়ে সামিরা তানজিন চৌধুরী হাইকোর্টে একটি রিট করেন। পরে সমাহিত বিএনপি নেতা হারিছ চৌধুরীর মরদেহ তুলে ডিএনএ পরীক্ষা করতে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।
গত ১৬ অক্টোবর হারিছ চৌধুরীর দেহাবশেষ কবর থেকে তোলা হয়। পরে ডিএনএ পরীক্ষা করার জন্য নমুনা সংগ্রহ করে সিআইডি। ডিএনএ পরীক্ষার পর মরদেহটি হারিছ চৌধুরীর কি না, সেটি নিশ্চিত হওয়া যাবে। ২১ অক্টোবর সিআইডির ফরেনসিক বিভাগে ডিএনএ নমুনা দেন হারিছ চৌধুরীর মেয়ে সামিরা তানজিন চৌধুরী।
সিআইডির ফরেনসিক বিভাগ সূত্রে জানা যায়, হারিছ চৌধুরীর দেহাবশেষের হাড় ও দাঁত থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। নমুনা সংগ্রহের পর ম্যাপিং প্রক্রিয়া চলছে। হারিছের মেয়ে সামিরা তানজিন চৌধুরীর রক্ত নেওয়া হয়েছে ডিএনএর নমুনা হিসেবে। এরপর কম্পিউটারাইজড পদ্ধতিতে ডিএনএ ম্যাচিং করা হবে। এই পদ্ধতিতেই জানা যাবে মরদেহ হারিছ চৌধুরীর কি না। তবে এটি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এক মাসেরও বেশি সময় লাগতে পারে ডিএনএ প্রতিবেদন প্রস্তুত করতে।
হারিছ চৌধুরীর ডিএনএ টেস্টের বিষয়ে জানতে চাইলে সিআইডির ফরেনসিক বিভাগের ডিআইজি মো. জামশের আলী বলেন, ‘ডিএনএ টেস্ট একটি সময়সাপেক্ষ বিষয়। দুজনের নমুনা ম্যাচিং শেষে কম্পিউটারাইজড পদ্ধতিতে ডিএনএ পরীক্ষার ফলাফল দেওয়া হবে। মরদেহের হাড় ও দাঁত থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে এবং তার মেয়ের রক্তের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে।’
হারিছ চৌধুরী মারা গেছেন কি না, মারা গেলে তার মৃত্যু লন্ডনে না ঢাকায়- এ নিয়ে অস্পষ্টতার মধ্যে ২০২২ সালের ৬ মার্চ মানবজমিন একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ‘হারিছ নয়, মাহমুদুর রহমান মারা গেছেন’ শিরোনামের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, হারিছ চৌধুরী দীর্ঘ ১৪ বছর দেশেই আত্মগোপনে ছিলেন। তিনি তার নাম-পরিচয় বদল করেন। নতুন নাম নেন ‘মাহমুদুর রহমান’। এই নামেই তিনি নতুন জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট করেন। তিনি প্রায় ১১ বছর ঢাকার পান্থপথে ছিলেন। নিজেকে একজন অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক বলে পরিচয় দিতেন। ২০২১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে মৃত্যুর পর তাকে সাভারে দাফন করা হয়।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর হারিছ চৌধুরীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। একই বছরের ২৯ অক্টোবর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় হারিছ চৌধুরীর সাত বছরের কারাদণ্ডের পাশাপাশি ১০ লাখ টাকা জরিমানা হয়। সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া হত্যা মামলার একজন আসামি তিনি। এমন একজন ব্যক্তির ১৪ বছর ধরে আত্মগোপনে থাকার বিষয়ে আদতে পুলিশের কাছে সে সময় কোনো নিশ্চিত তথ্য ছিল না।