মাওলানা আসগর সালেহী, দৈনিক আমার বাংলাদেশ প্রতিনিধিঃ
ধর্ষণ আজকের সমাজে এক ভয়াবহ ব্যাধি হিসেবে দেখা দিয়েছে। উন্নত, উন্নয়নশীল ও অনুন্নত—সব দেশেই এই জঘন্য অপরাধ বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু কেন? এর মূল কারণ কী? এবং এর স্থায়ী সমাধান কী হতে পারে? এ প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে হলে সমাজের অবক্ষয়, প্রচলিত আইন ও ইসলামের শাস্তি ব্যবস্থার মধ্যে তুলনামূলক বিশ্লেষণ করতে হবে।
ধর্ষণের সামাজিক কারণ: ধর্ষণ বৃদ্ধির পেছনে নানান সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক কারণ রয়েছে, যার মধ্যে অন্যতম হলো—
নৈতিক অবক্ষয় ও বেহায়াপনা: আধুনিক সমাজে অশ্লীলতা, পর্নোগ্রাফি, মাদক, খোলামেলা পোশাক ও যৌন উত্তেজক উপাদানের প্রসার ভয়াবহভাবে বেড়েছে। এগুলো মানুষের নফসকে দুর্বল করে তোলে এবং অপরাধ প্রবণতা বাড়ায়।
বিচারের দীর্ঘসূত্রতা ও শাস্তির ভয় না থাকা: প্রচলিত আইনে ধর্ষকদের জন্য শাস্তির বিধান থাকলেও, তা বাস্তবে কার্যকর হয় না। মামলার দীর্ঘসূত্রতা ও অপরাধীদের রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় শাস্তির হার কমিয়ে দিয়েছে।
ধর্মীয় ও পারিবারিক শিক্ষার অভাব: সমাজে যদি পবিত্রতা, লজ্জাশীলতা ও নৈতিক মূল্যবোধের চর্চা না থাকে, তাহলে অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পায়।
প্রচলিত আইনের দূর্বলতা ও ব্যর্থতা
ধর্ষণ দমনে প্রচলিত আইন ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে, কারণ—
দীর্ঘ তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়া: মামলাগুলো বছরের পর বছর ঝুলে থাকে।
দুর্নীতি ও প্রভাবশালী ধর্ষকদের রক্ষা করা: অনেক অপরাধী রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব খাটিয়ে শাস্তি এড়িয়ে যায়।
শাস্তির ভয়াবহতা নেই: ইসলামী দণ্ডবিধিতে যেখানে কঠোর ও দ্রুত শাস্তির বিধান রয়েছে, সেখানে প্রচলিত আইনে এতটাই দুর্বল ব্যবস্থা যে, অপরাধীরা ভয় পায় না।
ইসলামের দৃষ্টিতে ধর্ষণের শাস্তি
ইসলাম ধর্ষণকে (যিনার এক ভয়ংকর রূপ) কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছে এবং এর শাস্তি নির্ধারণ করেছে অত্যন্ত কঠোরভাবে। মহানবী (সা.) বলেন—
“যে ব্যক্তি বিবাহিত অবস্থায় ব্যভিচার করে, তাকে পাথর মেরে হত্যা করা হবে। আর যে অবিবাহিত অবস্থায় ব্যভিচার করে, তাকে ১০০ বেত্রাঘাত এবং এক বছর নির্বাসন দেওয়া হবে।” (সহিহ মুসলিম)
আর ধর্ষণ যদি প্রমাণিত হয়, তবে ইসলামী আইনে চারজন ন্যায়বান সাক্ষী থাকলে ধর্ষককে পাথর নিক্ষেপে হত্যা করা হবে, অথবা শরীর থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করা হবে।
কোরআন ও হাদিস অনুযায়ী ইসলামী শাসনের শ্রেষ্ঠত্ব
কোরআনে ধর্ষণ ও ব্যভিচারের শাস্তি সম্পর্কে বলা হয়েছে—
“ব্যভিচারিণী নারী ও ব্যভিচারী পুরুষ—তাদের প্রত্যেককে একশ’ বেত্রাঘাত কর। আল্লাহর বিধান কার্যকর করতে গিয়ে তাদের প্রতি যেন তোমাদের মনে দয়া উদ্রেক না হয়, যদি তোমরা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসী হয়ে থাক।” (সূরা নূর: আয়াত ২)
ইসলাম ধর্ষণ প্রতিরোধে পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা দিয়েছে
ইসলাম শুধু ধর্ষণের শাস্তির বিধান দেয়নি; বরং ধর্ষণ প্রতিরোধে এমন সব ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে, যা সমাজ থেকে এই ঘৃণ্য অপরাধ নির্মূল করতে পারে। নিম্নে কোরআন ও হাদিসের আলোকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরোধমূলক নির্দেশনা ও তাদের বাংলা অর্থ উল্লেখ করা হলো—
আল্লাহ বলেন:
“মুমিন পুরুষদের বলো, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে অবনত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে। এটি তাদের জন্য আরও পবিত্র। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদের কর্মকাণ্ড সম্বন্ধে সবিশেষ অবহিত। আর মুমিন নারীদের বলো, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে অবনত রাখে, নিজেদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে এবং তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে, তবে যা স্বাভাবিকভাবে প্রকাশিত হয় তা ছাড়া।” (সূরা আন-নূর: আয়াত ৩০-৩১)
“হে নবী! আপনি আপনার স্ত্রীগণ, কন্যাগণ এবং মুমিন নারীদের বলুন, তারা যেন নিজেদের উপর তাদের চাদরের কিছুটা টেনে নেয়। এতে তারা সহজেই চিনে নেওয়া যাবে এবং তাদের উত্ত্যক্ত করা হবে না। আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” (সূরা আহযাব: আয়াত ৫৯)
অশ্লীলতা ও ফিতনা থেকে দূরে থাকা সম্পর্কে আল্লাহ বলেন:
“তোমরা ব্যভিচারের ধারে-কাছেও যেও না। এটি নির্লজ্জ ও জঘন্য কাজ এবং খুবই খারাপ পথ।” (সূরা আল-ইসরা: আয়াত ৩২)
ব্যভিচার (যিনা) একটি ভয়াবহ অপরাধ, যা সমাজে ধর্ষণসহ নানা অনৈতিক কাজের পথ তৈরি করে। তাই ইসলাম কেবল ব্যভিচার নিষিদ্ধ করেনি, বরং এর কাছাকাছি যেতেও নিষেধ করেছে—যেমন, অশ্লীল কথাবার্তা, অশালীন পোশাক, মদ্যপান, পর্নোগ্রাফি দেখা, অবৈধ মেলামেশা ইত্যাদি।
যিনা ও ব্যভিচারের পথ রোধ করা সম্পর্কে হাদিসে এসেছে:
“তোমাদের কেউ যেন কোনো অপরিচিতা নারীর সঙ্গে নির্জনে অবস্থান না করে, কারণ শয়তান তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে সেখানে উপস্থিত থাকে।” (সহিহ বুখারি ও মুসলিম)
ইসলাম এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে, যাতে ধর্ষণ ও ব্যভিচারের মতো অপরাধের সুযোগই না থাকে। একান্তে নারী-পুরুষের মেলামেশা, অশ্লীল কথাবার্তা, নৃত্য-গীত ও অশালীন অনুষ্ঠানগুলো ইসলাম কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছে।
ব্যভিচারের সাজা মৃত্যুদণ্ড বা বেত্রাঘাত সম্পর্কে আল্লাহ বলেন:
“ব্যভিচারিণী নারী ও ব্যভিচারী পুরুষ—তাদের প্রত্যেককে একশ’ বেত্রাঘাত কর। আল্লাহর বিধান কার্যকর করতে গিয়ে তাদের প্রতি যেন তোমাদের মনে দয়া উদ্রেক না হয়, যদি তোমরা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসী হয়ে থাক।” (সূরা আন-নূর: আয়াত ২)
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন:
“যে ব্যক্তি বিবাহিত অবস্থায় ব্যভিচার করে, তাকে পাথর মেরে হত্যা করা হবে। আর যে অবিবাহিত অবস্থায় ব্যভিচার করে, তাকে ১০০ বেত্রাঘাত ও এক বছর নির্বাসন দেওয়া হবে।” (সহিহ মুসলিম)
ইসলাম শুধু উপদেশ দেয়নি, বরং কঠোর শাস্তির বিধান রেখেছে, যাতে সমাজে কেউ ব্যভিচার করার সাহস না পায়। আজকের সমাজে যদি ইসলামী শাসন ও শাস্তি কার্যকর থাকত, তাহলে ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ অনেকাংশে কমে যেত।
অপরাধীদের মনে ভয় জাগবে এবং ধর্ষণের হার নাটকীয়ভাবে কমে আসবে।
সমাজে নৈতিকতার উন্নতি হবে কারণ মানুষ ধর্মীয় ও আইনি শাস্তির ভয় পাবে।
নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে কারণ ইসলাম নারীদের পর্দা ও মর্যাদা রক্ষার ব্যবস্থা দিয়েছে।
দ্রুত ও কার্যকর বিচার সম্ভব হবে, কারণ ইসলামে সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে দ্রুত শাস্তি কার্যকর করা হয়।
সামাজিক প্রতিরোধ ও নারীদের দায়িত্ব
শুধু আইন প্রয়োগ করলেই সমস্যার সমাধান হবে না; বরং সমাজকেও সচেতন হতে হবে। এর জন্য—
নারীদের উচিত ইসলামি পর্দা মেনে চলা, যা তাদের সুরক্ষার জন্য অপরিহার্য।
পরিবার থেকে ধর্মীয় শিক্ষা দিতে হবে, যাতে শিশুদের মধ্যে নৈতিকতা গড়ে ওঠে।
অশ্লীলতা ও ব্যভিচার প্রসারকারী উপাদান নিষিদ্ধ করতে হবে।
ধর্ষণ দমন করতে হলে একমাত্র ইসলামী শাসন ব্যবস্থার প্রয়োজন। ইসলামী বিধান বাস্তবায়ন করলে দ্রুত ও কঠোর শাস্তি নিশ্চিত হবে, যা অপরাধ প্রবণতা কমিয়ে দেবে। ইতিহাস সাক্ষী, ইসলামী শাসনে অপরাধীর সংখ্যা সবচেয়ে কম ছিল। কিন্তু বর্তমান প্রচলিত আইন ও বিচারব্যবস্থা দুর্বল হওয়ায় সমাজে ধর্ষণ ক্রমেই বাড়ছে।
অতএব, যদি সত্যিই ধর্ষণ বন্ধ করতে হয়, তাহলে কোরআন-সুন্নাহ মোতাবেক কঠোর আইন প্রণয়ন করতে হবে এবং মহানবী (সা.)-এর শাসন পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। অন্যথায়, আধুনিক দুর্বল আইনে ধর্ষণ বন্ধ করা অসম্ভব!
লেখক: মাওলানা আসগর সালেহী
সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী।