মাওলানা আসগর সালেহী
মানব ইতিহাসের প্রতিটি অধ্যায়ে মানুষ তার মুক্তি, ন্যায়বিচার ও শান্তির সন্ধান করেছে। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, প্রজাতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র, কমিউনিজম, ফ্যাসিবাদ, পুঁজিবাদ, সাম্যবাদ, মার্ক্সবাদ, লেনিনবাদ, স্ট্যালিনবাদ ও মাওবাদসহ এযাবৎকাল পর্যন্ত যত মতবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তার প্রত্যেকটি একপর্যায়ে এসে ব্যর্থ হয়েছে। কারণ এগুলোর প্রতিটি মানবসৃষ্ট মতবাদ, যার মূল ভিত্তিই ত্রুটিপূর্ণ। এসব মতবাদ মানবতার প্রকৃত মুক্তি দিতে পারেনি, বরং শোষণ, বৈষম্য, যুদ্ধ, দারিদ্র্য ও অশান্তি সৃষ্টি করেছে।
আজকের বিশ্ব আরও বেশি বিশৃঙ্খল। একদিকে অর্থনৈতিক বৈষম্য, সামাজিক অবিচার ও রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের বেড়াজালে বন্দী মানবতা; অন্যদিকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির দমন-নিপীড়নের শিকার সাধারণ মানুষ। এই পরিস্থিতিতে মানুষ এমন এক আদর্শের দিকে তাকিয়ে আছে, যা কেবল সাম্য, সামাজিক ন্যায়বিচার ও ইনসাফভিত্তিক সমাজই প্রতিষ্ঠা করবে না, বরং মানবতার চূড়ান্ত মুক্তির পথ দেখাবে। এবং সেই আদর্শ একমাত্র ইসলাম।
ইসলাম কেবল একটি ধর্ম নয়, এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, যা ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য সর্বোৎকৃষ্ট নীতিমালা প্রদান করে। ইসলাম এমন এক ব্যবস্থা প্রবর্তন করে, যেখানে শোষণ নেই, বৈষম্য নেই, অন্যায়ের কোনো স্থান নেই। এটি এমন এক নীতিভিত্তিক ব্যবস্থা, যা মানুষের সকল মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করে, ধনী-গরিবের বৈষম্য দূর করে, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করে এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পথ দেখায়।
পৃথিবীর ইতিহাস সাক্ষী যে, যখনই ইসলামিক নীতিমালা অনুসারে কোনো রাষ্ট্র পরিচালিত হয়েছে, তখনই সেখানে শান্তি, সমৃদ্ধি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মহানবী (সা.)-এর মদিনার রাষ্ট্রব্যবস্থা এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ, যেখানে সব ধর্ম-বর্ণের মানুষ ন্যায়বিচার ও সাম্যের ছায়ায় নিরাপদ জীবনযাপন করেছিল। খোলাফায়ে রাশেদিনের শাসনামল, উমাইয়া, আব্বাসীয় ও উসমানীয় খেলাফতের সময়ে ইসলামিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা কেবল মুসলমানদের নয়, বরং গোটা মানবজাতির মুক্তির দিশারি হয়েছিল।
বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ বরাবরই একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূখণ্ড। দক্ষিণ এশিয়ায় এর কৌশলগত অবস্থান, অর্থনৈতিক সম্ভাবনা, সাংস্কৃতিক প্রভাব এবং আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর স্বার্থের কেন্দ্রে থাকায় বাংলাদেশ সবসময়ই বৈশ্বিক রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর নীতি ও কৌশলের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ।
গত জুলাই বিপ্লবে ফ্যাসিবাদের পতনের পর বাংলাদেশে দেশপ্রেমিক ও ইসলামি শক্তির উত্থানের এক নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। জনগণ বুঝতে পারছে, পাশ্চাত্য উদ্ভূত গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র কিংবা পুঁজিবাদ তাদের সমস্যার কোনো সমাধান দিতে পারেনি। ফলে মানুষ প্রকৃত বিকল্পের দিকে তাকিয়ে আছে, আর সেই বিকল্প একমাত্র ইসলামী শাসনব্যবস্থা।
কিন্তু এই সুযোগ বারবার আসে না। যদি এবারও ভুল করা হয়, তাহলে অন্তত একশো বছর পিছিয়ে পড়তে হবে। তাই দেশপ্রেমিক ইসলামী শক্তিগুলোকে অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। কথাবার্তা বলার সময় তার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, লাভ-ক্ষতির হিসাব করেই বলা উচিত। অতীতের মতো ভুল করলে সম্ভাবনার এই ধার রুদ্ধ হয়ে যাবে।
বিশ্ব পরাশক্তিগুলো কখনোই চায় না যে, বাংলাদেশে সাম্যের সমাজ প্রতিষ্ঠা হোক বা ইসলামী শক্তির উত্থান ঘটুক। বরং তারা চায়, বাংলাদেশ এমন এক রাষ্ট্র হিসেবে থাকুক, যেখানে তাদের স্বার্থ রক্ষা করা সহজ হয়। ফলে তারা ইসলামী শক্তির বিরুদ্ধে নানা চক্রান্ত করবে—অর্থনৈতিক অবরোধ, মিডিয়া প্রোপাগান্ডা, রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র কিংবা সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে ইসলামী শক্তিকে দমন করার চেষ্টা করবে।
এ অবস্থায় দেশপ্রেমিক ইসলামী শক্তিগুলোকে বুদ্ধিমত্তা, কৌশল, ঐক্য ও সুসংগঠিত পরিকল্পনার মাধ্যমে কাজ করতে হবে। আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য কূটনৈতিক দক্ষতা বাড়াতে হবে, পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরীণ শক্তিগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। যদি ইসলামী নেতৃত্ব বাস্তববাদী, সুপরিকল্পিত এবং জনগণের আস্থাভাজন হতে পারে, তাহলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এক নতুন মোড় নেবে।
সুতরাং, এখন সময় মতবিরোধে জড়ানোর নয়, বরং ঐক্যবদ্ধ হওয়ার। অতীতের বিভক্তি, মতপার্থক্য ও ক্ষুদ্র স্বার্থপরতা ইসলামী শক্তির অগ্রযাত্রাকে বারবার বাধাগ্রস্ত করেছে। আমরা যদি একই ভুল বারবার করি, তাহলে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না। ইসলামের মৌলিক আদর্শ—সাম্য, ন্যায়বিচার ও ইনসাফ—এই তিন ভিত্তির ওপর ঐক্যবদ্ধ থাকাই আমাদের প্রধান দায়িত্ব। ব্যক্তি, দল বা গোষ্ঠীগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে, ইসলামের মহান আদর্শকে সামনে রেখে আমাদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে। কারণ ইসলাম কোনো নির্দিষ্ট দলের নয়, এটি সমগ্র মানবতার মুক্তির একমাত্র পথ। যদি আমরা সত্যিই ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চাই, তবে আমাদের পারস্পরিক বিরোধ ভুলে “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ”-এর পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, নতুবা সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাবে, এবং পরিণতিতে আবারও অন্যদের শাসন-শোষণের শিকার হতে হবে।
আগামী শতাব্দী হবে ইসলামী জাগরণের শতাব্দী—এই বিশ্বাস ও প্রত্যয়ে আমাদের কাজ করতে হবে। মতপার্থক্যের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে এসে ইসলামের মৌলিক শিক্ষা অনুযায়ী ঐক্যবদ্ধ হওয়াই একমাত্র পথ।
ইতিহাস সাক্ষী, ইসলামই একমাত্র মতবাদ যা মানুষের প্রকৃত মুক্তির নিশ্চয়তা দিতে পারে। মানবতার প্রতিটি সংকটের সমাধান ইসলামে বিদ্যমান। এটি কোনো মানুষের তৈরি মতবাদ নয়, বরং এটি আল্লাহ প্রদত্ত একমাত্র সত্য ও চূড়ান্ত জীবনব্যবস্থা।
আজকের পৃথিবীতে মানুষ ন্যায়বিচার, সাম্য ও ইনসাফের তৃষ্ণায় কাতর। ইসলামই একমাত্র আদর্শ, যা নির্যাতিত, নিষ্পেষিত, বঞ্চিত ও লাঞ্ছিত মানুষের অধিকার ফিরিয়ে দিতে পারে। অতএব, সময় এসেছে বিভক্তি ভুলে একটি ইনসাফভিত্তিক, বৈষম্যহীন ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার।
এটি কেবল বাংলাদেশের জন্য নয়, বরং গোটা বিশ্বের জন্য একটি দিকনির্দেশনা। ইসলামী আদর্শ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মানবতার মুক্তি নিশ্চিত করতে হবে, কারণ ইসলামই একমাত্র সত্য ও কল্যাণের পথ। ইতিহাস আমাদের ডাকছে—আমরা কি প্রস্তুত?
লেখক: মাওলানা আসগর সালেহী
সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী