মোঃ আমিরুল হক, রাজবাড়ী প্রতিনিধিঃ
রাজবাড়ীর রামদিয়ার তিলের মটকার সুপরিচিতি রয়েছে সারাদেশজুড়ে। সুমিষ্ট, সুস্বাদ আর চমৎকার ঘ্রাণের কারণে বিখ্যাত এ তিলের মটকা।
জেলার বালিয়াকান্দি উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের প্রায় অর্ধশত পরিবার এ তিলের মটকা তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে।
সম্প্রতি উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের রামদিয়া রেলওয়ে স্টেশনে গিয়ে জানা যায়, রেলওয়ে স্টেশনের আশপাশে কাউন্নাইন গ্রামের বেশ কয়েকজন মটকার কারিগর তিলের মটকা তৈরি করেন।
স্থানীয়রা বলেন, শতাধীক বছরেরও আগে রামপ্রসাদ নামে এক ব্যক্তি প্রথম এখানে তিলের মটকা তৈরি শুরু করেন। তিল, চিনিসহ বিভিন্ন মসলা জাতীয় উপকরণ দিয়ে তৈরি তার মটকার সুখ্যাতি ছিল বৃহত্তর ফরিদপুরসহ সারা দেশজুড়ে। রামপ্রসাদের নামেই রামদিয়ার মটকা বলে সবাই চেনে। তিনি মারা যাওয়ার পর তার পরিবার এখান থেকে পাশ্ববর্তী দেশে চলে গেছে। বর্তমানে যারা মটকা তৈরি করেন তাদের মধ্যে আবদুল আলীমের মটকা বিখ্যাত, সুমিষ্ট ও সুস্বাদু।
রামদিয়ায় আবদুল আলীমের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, রেলওয়ে স্টেশনের পাশের একটি ঘরে মটকা তৈরির বিভিন্ন উপকরণ রয়েছে। দুপুরে তিনি মটকা তৈরিতে বসেন। প্রথমে মাটির চুলায় লোহার বড় কড়াইয়ে চিনি ও পানি দিয়ে জাল দেওয়া হয়। উত্তপ্ত তাপে চিনি ও পানি থেকে হওয়া শিরা দিয়ে তৈরি হয় রামদিয়ার তিলের মটকা। এখানকার মটকার বয়স প্রায় দেড় শত বছর। এ মটকা বিদেশে রপ্তানি করার সুযোগ রয়েছে। স্বাদ ও ঐতিহ্য ধরে রাখার পাশাপাশি অর্থনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে। এ সুস্বাদু খাবারের… শিরা তৈরির জন্য দিতে হয় দুধের ছানার পানি। এ পানি মূলত শিরা তৈরি করে। প্রচন্ড তাপে চিনি, পানি ও ছানার পানি সংমিশ্রণ শিরায় পরিণত হয়। সেই শিরা রাখা হয় মাটির পাত্রতে (মালসা)। মালসার শিরা কাঠের পাটাতনে ঢালা হয়। সেই শিরায় দেওয়া হয় এলাচের গুঁড়া এবং ঘি। এরপর কাঠের কান্ডের সঙ্গে লালচে শিরা টেনে সাদা রং হয়। শিরা দড়ির মতো হওয়ার পর সেগুলো কেটে কেটে গোলাকার করা হয়। গোলাকার অংশ গরম তিলের শাঁসের সঙ্গে মিশিয়ে তৈরি করা হয় তিলের মটকা। এরপর প্যাকেটজাত করা হয় বিক্রির উদ্দেশ্যে।
কালুখালী থেকে ছেড়ে আসা ভাটিয়াপসড়া-ভাঙ্গা ট্রেনতে কথা হয় কাশিয়ানীর ট্রেন যাত্রী রবিউল ইসলাম (৫৫) এর সাথে। তিনি বলেন, আমার এক আত্মীয় বাড়ী কালুখালীতে আগের দিনে বাবার সাথে বেড়াতে এলে ট্রেনের কামরায় কামরায় মটকা বিক্রেতাগণ মধুর সুরে বলতেন “এই রামদিয়ার রাম বাবুর মটকা, স্বাদে গন্ধে অতুলনীয় এই মটকা খান, বাড়ীর ছোটছোট ছেলে মেয়েদের জন্য নিয়ে যান।” এদের এমন সুরেলা ডাকাডাকি শুনে বাবা ট্রেনের ভিতর থেকে রামদিয়ার তিলের মটকা কিনে দিতেন। আমরা ভাই-বোনরা মিলে তা মজা করে খেতাম। এখনও দেখছি সেই শিল্পটা রয়ে গেছে। বেশ কয়েকজন ট্রেনের ভিতর রামদিয়ার মটকা বিক্রি করছেন।
তিলের মটকার কারিগর আবদুল আলিম বলেন, রামদিয়ার তিলের মটকা সারাদেশের মধ্যে বিখ্যাত। শত বছরের পুরোনো ঐতিহ্য এ তিলের মটকা। খেতে খুব সুমিষ্ট ও সুস্বাদু। এটি জিআই পণ্য হিসেবে তালিকাভুক্ত হওয়া উচিত। বর্তমানে প্রায় অর্ধশত পরিবার তিলের মটকা তৈরি করে। মটকার সুনাম ধরে রাখার জন্য সরকারের নজরদারি প্রয়োজন বলে জানান তিনি। তিনি আরও বলেন, ‘আমি প্রতি কেজি তিলের মটকা ৬০০ টাকা থেকে ১৪০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করে থাকি।’
স্থানীয়রা বলেন, রামদিয়ার তিলের মটকার বয়স প্রায় দেড় শ বছর। এ মটকা শিল্পে পরিণত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তিলের মটকা তৈরির কারিগর কমে আসছে। তিলের মটকা বিদেশে রপ্তানি করার সুযোগ রয়েছে। স্বাদ ও ঐতিহ্য ধরে রাখার পাশাপাশি অর্থনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে এ সুস্বাদু তিলের মটকার।
রাজবাড়ীর জেলা প্রশাসক মিজ সুলতানা আক্তার বলেন, বালিয়াকান্দির ইসলামপুর ইউনিয়নের রামদিয়ার তিলের মটকা নিয়ে কাজের সুযোগ আছে। আমরা জেলা প্রশাসন থেকে তিলের মটকার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব জেনে কাজ করব।