মোহাম্মদ ইমতিয়াজ উদ্দিন, জবি প্রতিনিধিঃ
পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দুই যুগ হতে চলল কিন্তু নেই কোনো ছাত্র সংসদের নিয়ম। সর্বশেষ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯৯তম(২ জানুয়ারি) সিন্ডিকেট সভায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী সংসদ (জকসু)-এর নীতিমালার চূড়ান্ত খসড়া অনুমোদিত হয়। জানা যায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও রাষ্ট্রপ্রতির আদেশ পেলেই নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করবে জবি প্রশাসন।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পরে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার থাকাকালীন জকসু নির্বাচন চান একাধিক ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। এখন যদি ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয় তাহলে সুষ্ঠু নির্বাচন ও শিক্ষার্থীবান্ধব নেতৃত্ব তৈরি হবে। এছাড়া জুলাইয়ের অন্যতম স্পিরিট স্থিতিশীল ক্যাম্পাস জকসু নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিফলিত হবে বলে মনে করেন তারা।ফ্যাসিবাদমুক্ত ক্যাম্পাস ও সংস্কারের পর জকসু নির্বাচন চায় ছাত্রদল,ক্যাম্পাসের সুষ্ঠ ধারার রাজনীতি চাই ছাত্রশিবির,দ্রুত জকসু নির্বাচন চায় ইসলামী ছাত্র আন্দোলন, ছাত্র ফ্রন্ট, ছাত্র অধিকার পরিষদ।দ্রুত জকসু নির্বাচন চায় সাধারণ শিক্ষার্থীরাও। শিক্ষক সমিতি, কর্মকর্তা-কর্মচারী নির্বাচন হলেও সবসময় বাঁধা পেয়েছে জকসু নির্বাচন। এর মধ্যে বেশিরভাগ সময় আইনে বিধি না থাকায় নির্বাচন দিতে ব্যর্থ হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
জানা যায়, ১৯৫৪ সালে জগন্নাথ কলেজ থাকাকালীন প্রথম ছাত্রসংসদ নির্বাচন হয়। সেসময় জগন্নাথ কলেজ ছাত্র সংসদ (জকসু) বলা হতো। এ নির্বাচনে ভিপি এআর ইউসুফ আর জিএস সালাউদ্দিন আহমেদ নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত জগন্নাথ কলেজ ছাত্রসংসদের ১০টি কমিটি হয়। স্বাধীনতার পরে ১৯৭২, ১৯৭৯, ১৯৮৬, ১৯৮৭ সালে আরও চারটি ছাত্রসংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৮৭ সালে সর্বশেষ জকসু নির্বাচন হয়।
২০০৫ সালে জগন্নাথ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় রূপান্তরিত হওয়ার আগ পর্যন্ত ১৮ বছর ধরে কোনো ছাত্রসংসদ নির্বাচন হয়নি। এরপর জগন্নাথ কলেজ থেকে ২০০৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হওয়ার সময় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০০৫ এ ছাত্রসংসদের অধ্যাদেশযুক্ত হয়নি।
বিশ্ববিদ্যালয় আইনে ছাত্র সংসদের ধারা প্রনয়ণ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে আলোচনা সমালোচনা চললেও হয়নি বাস্তবায়ন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে জবি ভিসি অধ্যাপক রেজাউল করিম বলেন বিগত ৯৯ তম সিন্ডিকেট মিটিংয়ে জকসু নীতিমালার চূড়ান্ত খসড়া অনুমোদিত হয়েছে।আমরা সবকিছু ঢেলে সাজাচ্ছি,বাংলাদেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের মত আমাদেরও ছাত্র সংসদ নির্বাচন হবে। তবে একটু দেরি হচ্ছে।আজ বললাম কাল হয়ে গেলো এটা তেমন বিষয় নয়।
তিনি আরো বলেন যেহেতু জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন-২০০৫ এ ছাত্রসংসদ নির্বাচন নিয়ে কোন ধারা বা বিধি নেই, তাই অনুমোদিত নীতিমালাটি এখন আমাদের আইন উপদেষ্টাদের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হবে। মন্ত্রণালয় হয়ে রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে অধ্যাদেশ জারি হলে এটি আইন হিসেবে গৃহীত হবে।
ফ্যাসিবাদমুক্ত ক্যাম্পাস ও সংস্কারের পর জকসু নির্বাচন চায় ছাত্রদল:
সংগঠনটির আহ্বায়ক মেহেদী হাসান হিমেল বলেন, জুলাই-আগস্টের পূর্ববর্তী ও আন্দোলনের সময়ে গত ১৭ বছর যারা আমাদের নেতাকর্মীদের উপর হামলা-মামলা ও নির্যাতন করেছে। আমরা চাই তাদের বিচারের আওতায় আনা হোক। ফ্যাসিবাদ মুক্ত ক্যাম্পাস গড়ে তুলে তারপর জকসু নির্বাচন হোক।
সদস্য সচিব শামসুল আরেফিন বলেন, আওয়ামী লীগের প্রশাসনের পিছনে অনেক ছায়া প্রশাসন ছিল। ছায়া প্রশাসনের নির্ভরতা থেকে অনেকে বলতে চায় ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়ে গেলে অনেক অর্জন হয়ে যাবে। কিন্তু আমাদের মোড়কের পরিবর্তন প্রয়োজন নয়, আমাদের গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের ইন্টার্নাল প্রত্যকটি প্রশাসনের প্রয়োজন। একইভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এই পরিবর্তন প্রয়োজন।
সুষ্ঠ ধারার ছাত্র রাজনীতি চাই জবি ছাত্র শিবির:
সংগঠনটির সেক্রেটারি রিয়াজুল ইসলাম বলেন জুলাই পরবর্তী সময়ে আমরা চাই ক্যাম্পাসে সুষ্ঠ ধরার রাজনীতি চর্চা হোক।যত দ্রুত সম্ভব জকসু নির্বাচন হোক,জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে আজও ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়নি।দ্রুত প্রশাসনকে আহ্বান করছি জকসু নির্বাচন দেওয়ার জন্য।
দ্রুত জকসু নির্বাচন চায় ইসলামী ছাত্র আন্দোলন, ছাত্র ফ্রন্ট, ছাত্র অধিকার পরিষদ:
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রফ্রন্টের মতে, বিশ্ববিদ্যালয় আইনে ছাত্র সংসদ (জকসু) নির্বাচন সংযুক্ত করে দ্রুতই নির্বাচন দেওয়া উচিত। ক্যাম্পাসে গনতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতেও এই প্রক্রিয়া আনা জরুরি বলে মনে করেন তারা। ছাত্র সংসদ নির্বাচনকে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পরিপূরক আকাঙ্ক্ষা মনে করে দ্রুতই জকসু নির্বাচন চান তারা।
বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রফ্রন্টের সভাপতি ইভান তাহসীভ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে ছাত্রসংসদ নির্বাচন নিয়ে বিধি নেই। কিন্তু নির্বাচন নিয়ে শিক্ষার্থীদের যে আকাঙ্ক্ষা সেই আকাঙ্ক্ষার জায়গা থেকে নীতিমালা গুলো সংযুক্ত করে নেওয়া যায়। আর এই নীতিমালা প্রণয়ন করার ক্ষেত্রে ছাত্রসংগঠনগুলোর মতামত নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। যে খসড়া নীতিমালা আলোচনা হয়েছে তা সকল ছাত্র সংগঠনগুলোর কাছে পৌঁছানো এবং ছাত্র প্রতিনিধিদের মতামতের ভিত্তিতে নীতিমালা প্রতিষ্ঠা করা জরুরি।
ছাত্র অধিকার পরিষদ মনে করে শিক্ষাথীদের অধিকার নিয়ে কাজ করবে ছাত্র সংসদ। ৫ আগস্টের পর ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়ে শিক্ষার্থীদের চাওয়া অনেক বেশি। বিগত ১৫ বছরে ছাত্রদের দাবানো কষ্টগুলো এই চাওয়ার মধ্যেই উঠে আসছে। তাই এ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্যম্পাস গুলো স্থিতিশীল করতে দ্রুত জকসু নির্বাচন চায় সংগঠনটি। সেই জায়গা থেকে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় গুলো ছাত্র সংসদ নির্বাচন করল কিনা এটা না দেখে জকসু নির্বাচন দেওয়া উচিত বলে মনে করে তারা।
এবিষয়ে শাখা ছাত্র অধিকার পরিষদের সভাপতি এ কে এম রাকিব বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের কী চাহিদা, তাদের কী প্রয়োজন এগুলো ছাত্র সংসদের নেতারাই তুলে ধরতে পারবেন৷ শিক্ষকরা সেটা বুঝবেন না এবং তুলেও ধরতে পারবেন না। সেই জায়গা থেকে যতদ্রুত সম্ভব ছাত্র সংসদ নির্বাচন (জকসু) নির্বাচন হওয়া দরকার।
দ্রুত জকসু নির্বাচন চায় সাধারণ শিক্ষার্থীরা:
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নানামূখী সংকট নিয়ে কাজ করবে ছাত্র সংসদ। শিক্ষার্থীদের সমস্যাগুলো তুলে ধরবে বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষের কাছে। এছাড়া ছাত্র সংসদ হলে কোনো রাজনৈতিক সংগঠন একক আধিপত্য করতে পারবে না বলে মনে করে সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
বিশ্ববিদ্যালয় আইনে জকসু নীতিমালা সংযুক্তির জন্য গঠিত কমিটির অগ্রগতি:
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় আইনে জকসু নীতিমালা সংযুক্তির জন্য ৬সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. মো. রইছ উদ্দীন রইছ উদ্দীন বলেন, জকসু নীতিমালা প্রণয়নে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। আমরা কমিটির সদস্যরা নীতিমালার খসড়া প্রশাসনের কাছে হস্তান্তর করে দিয়েছি। এরপর কাজ কতদূর সেটা প্রশাসনিক দপ্তরই বলতে পারবে।
ছাত্র কল্যাণ পরিচালক অধ্যাপক ড. কে এ এম রিফাত হাসান বলেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে জকসু নীতিমালা নেই। তবে খসড়া নীতিমালা প্রস্তাব করা হয়েছে। এই নীতিমালা শিক্ষা মন্ত্রণালয় হয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে যাবে। রাষ্ট্রপতি অনুমোদন দিলে তারপরই আমরা জকসু নির্বাচন নিয়ে সামনে এগোতে পারবো।