মাওলানা আসগর সালেহীঃ
পরিবেশ সংরক্ষণ কেবল আধুনিক বিজ্ঞান বা নীতিনৈতিকতার বিষয় নয়; এটি ইসলামেরও অন্যতম মৌলিক শিক্ষা। মহান আল্লাহ মানুষকে পৃথিবীতে খলিফা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন এবং তার দায়িত্ব হিসেবে পরিবেশ রক্ষা করার নির্দেশ দিয়েছেন। কুরআন ও হাদিসে এ বিষয়ে অসংখ্য দিকনির্দেশনা রয়েছে, যা আজকের পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
পরিবেশ আমাদের নানাভাবে উপকৃত করে, যা আমাদের দৈনন্দিন জীবন, স্বাস্থ্য এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। যেমন-
১. অক্সিজেন ও বিশুদ্ধ বায়ু সরবরাহ
গাছপালা কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে অক্সিজেন সরবরাহ করে, যা আমাদের বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য।
২. খাবার ও পানি সরবরাহ
আমাদের খাবার ও পানীয় জল সরাসরি প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল। নদী, জলাশয় ও বনজ সম্পদ আমাদের বিশুদ্ধ পানি ও খাদ্যের জোগান দেয়।
৩. আবহাওয়া ও জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ
বনভূমি এবং সাগর জলবায়ুকে নিয়ন্ত্রণ করে, অতিরিক্ত তাপমাত্রা বাড়তে দেয় না এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে।
৪. আশ্রয় ও বসবাসের পরিবেশ তৈরি
আমাদের ঘরবাড়ি, আসবাবপত্র, পোশাকসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র প্রাকৃতিক সম্পদ থেকে পাওয়া যায়।
৫. প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধ
বনভূমি ও পাহাড় ভূমিধস, বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব কমাতে সহায়তা করে।
৬. স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন নিশ্চিত করা
পরিষ্কার পানি, বিশুদ্ধ বাতাস ও সবুজ প্রকৃতি আমাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।
৭. অর্থনৈতিক সুবিধা প্রদান
কৃষি, বনজ সম্পদ, পর্যটন ও মৎস্য খাত আমাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে।
১. পরিবেশ সংরক্ষণের ইসলামী নীতি
ক. পৃথিবী আল্লাহর নিয়ামত
আল্লাহ তাআলা বলেন—
“তিনিই সেই সত্তা, যিনি তোমাদের জন্য পৃথিবীকে বাসযোগ্য করেছেন এবং তাতে জীবিকার উপাদান সৃষ্টি করেছেন।” (সূরা আল-মুলক, আয়াত: ১৫)
এ আয়াত থেকে বোঝা যায়, পরিবেশ আমাদের জন্য এক মহান নিয়ামত। তাই এটিকে ধ্বংস করা কৃতজ্ঞতার পরিপন্থী।
খ. গাছপালা ও সবুজায়নের গুরুত্ব
হাদিসে রাসুল (সা.) বলেছেন—
“যদি কিয়ামতের আগ মুহূর্তেও তোমাদের কারও হাতে একটি চারাগাছ থাকে, আর তা রোপণ করা সম্ভব হয়, তবে সে যেন তা রোপণ করে।” (মুসনাদ আহমদ)
এ হাদিস থেকে বোঝা যায়, গাছ লাগানো ও প্রকৃতি সংরক্ষণ ইসলামে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত।
গ. পানি ও প্রাকৃতিক সম্পদের অপচয় নিষেধ
রাসুল (সা.) বলেছেন—
“তোমরা প্রবাহমান নদীতেও অযথা পানি অপচয় করো না।” (সুনান ইবনে মাজাহ)
আজকের বিশ্বে যেখানে পানি সংকট দেখা দিচ্ছে, সেখানে এ হাদিসের শিক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ঘ. প্রাণিকুলের প্রতি সদয় আচরণ
রাসুল (সা.) বলেছেন—
“একজন নারীকে কেবল এই কারণে জাহান্নামে পাঠানো হয়েছে যে, সে একটি বিড়ালকে আটকে রেখে খাবার দেয়নি এবং মুক্তিও দেয়নি যাতে সে নিজে খাবার সংগ্রহ করতে পারে।” (সহিহ বুখারি)
এই হাদিস থেকে বোঝা যায়, শুধু মানুষ নয়, জীবজগতের প্রতিও সদয় আচরণ করতে হবে।
২. পরিবেশ দূষণ রোধে ইসলামের নির্দেশনা
ক. বায়ু দূষণ ও আবর্জনা ফেলা নিষেধ
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন—
“বিশুদ্ধতা ঈমানের অর্ধেক।” (সহিহ মুসলিম: ২২৩)
এ ছাড়া, রাসুল (সা.) রাস্তা ও জনসমাগমস্থলে ময়লা-আবর্জনা ফেলার কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন।
খ. খাদ্য অপচয় নিষিদ্ধ
কুরআনে এসেছে—
“তোমরা অপচয় করোনা; নিশ্চয়ই অপচয়কারীরা শয়তানের ভাই।” (সূরা আল-ইসরা, আয়াত: ২৭)
অতিরিক্ত ভোগবাদিতা ও খাদ্য অপচয়ের কারণে পরিবেশের ওপর যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, তা রোধে এ আয়াত গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দেয়।
গ. পশু-পাখির বাসস্থান ধ্বংস না করা
রাসুল (সা.) বলেছেন—
“যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে কোনো গাছ কাটে বা কোনো পাখির বাসা নষ্ট করে, সে আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হবে।” (আবু দাউদ)
এ হাদিস থেকে বোঝা যায়, জীবজগতের বাসস্থান সংরক্ষণ ইসলামের অন্যতম শিক্ষা।
৩. পরিবেশ রক্ষায় আমাদের করণীয়
ক. বৃক্ষরোপণ করা ও গাছ কাটা থেকে বিরত থাকা।
খ. পানি ও বিদ্যুৎ অপচয় রোধ করা।
গ. প্লাস্টিক ও রাসায়নিক বর্জ্য কমানো এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য জিনিস ব্যবহার করা।
ঘ. প্রাণিকুলের প্রতি সদয় আচরণ করা ও তাদের আবাসস্থল সংরক্ষণ করা।
ঙ. পরিবেশবান্ধব জীবনযাপন করা ও অন্যদেরও সচেতন করা।
পরিবেশ রক্ষায় ইসলামের শিক্ষা আজকের বিশ্বে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। কুরআন ও হাদিসের নির্দেশনা অনুসরণ করলে আমরা একটি সুন্দর ও বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ে তুলতে পারি। আমাদের উচিত প্রকৃতিকে আল্লাহর এক মহামূল্যবান আমানত হিসেবে সংরক্ষণ করা এবং পরিবেশবান্ধব জীবনযাপন করা।
লেখক : মাওলানা আসগর সালেহী
সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী
ফটিকছড়ি, চট্টগ্রাম।