মার্কিন প্রেসিডেন্ট সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে নির্বাচিত না হয়ে ইলেকটোরাল কলেজ নামে একটি ব্যবস্থার মাধ্যমে নির্বাচিত হন। কিন্তু এই ইলেকটোরাল কলেজ কিভাবে কাজ করে?
ইলেকটোরাল কলেজ কিভাবে কাজ করে
তাত্ত্বিকভাবে মার্কিন সরকার সমন্বিত নির্বাহী বিভাগ (রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রিসভা), বিচার বিভাগীয় বিভাগ (সুপ্রিমকোর্ট) এবং আইনপ্রণয়ন বিভাগ (কংগ্রেস) নিয়ে গঠিত। কংগ্রেস আবার গঠিত দুটি সত্তা নিয়ে-হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভস ও সিনেট। সিনেটে প্রতিটি রাজ্যের দুজন করে সদস্য থাকেন। তারা ফেডারেল স্তরে পুরো রাজ্যের প্রতিনিধিত্ব করেন। হাউজের প্রতিনিধিরা একটি রাজ্যের মধ্যে পৃথক জেলার প্রতিনিধিত্ব করেন। একটি রাজ্যে কংগ্রেসের কতজন প্রতিনিধি থাকবেন, সেটি আদমশুমারির মাধ্যমে নির্ধারিত হয়। দেশটিতে ১০ বছর পরপর আদমশুমারি অনুষ্ঠিত হয়।
ক্যালিফোর্নিয়া হলো সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ রাজ্য, তাই এর প্রতিনিধির সংখ্যাও সর্বোচ্চ ৫২। অপেক্ষাকৃত ছোট জনসংখ্যার রাজ্য, যেমন আলাস্কায় কংগ্রেসের প্রতিনিধিমাত্র একজন।
প্রতিটি মার্কিন রাজ্য তার কংগ্রেসের প্রতিনিধিদলের প্রত্যেক সদস্যের জন্য একটি ইলেকটোরাল কলেজের ভোট পায়। এর মানে ক্যালিফোর্নিয়ায় ৫৪টি ইলেকটোরাল কলেজের ভোট রয়েছে ৫২টি হাউজ প্রতিনিধিদের জন্য এবং দুটি সিনেটরদের জন্য। আলাস্কার রয়েছে তিনটি ভোট, একটি তার হাউজ প্রতিনিধির জন্য এবং দুটি সিনেটরদের জন্য। সব মিলিয়ে কংগ্রেসের সদস্য রয়েছেন ৫৩৫ জন এবং ওয়াশিংটন ডিসিতে রয়েছেন তিনজন নির্বাচক। অর্থাৎ মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদের জন্য ৫৩৮টি ইলেকটোরাল ভোট রয়েছে-নির্বাচনে জয়ী হওয়ার জন্য প্রয়োজন এর অধিকাংশ, অন্তত ২৭০টি।
কেন এ ব্যবস্থা
১৭৮৭ সালে মার্কিন সংবিধানপ্রণেতারা এ পদ্ধতি চালু করেন। ব্রিটেন থেকে যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা পাওয়ার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছিল একেবারেই নতুন একটি দেশ। যুক্তরাষ্ট্রের ফাউন্ডিং ফাদার্স হিসাবে পরিচিত ব্যক্তিরা এমন একটি নির্বাচনিব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, যা ক্ষমতাকে একজনের হাতে কেন্দ্রীভূত করবে না। রাজতন্ত্রের মতো কাঠামো তৈরি করতে পারে এমন ব্যবস্থা থেকে তারা নিজেদের মুক্ত করতে চেয়েছিলেন।
কিন্তু সম্পূর্ণরূপে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হওয়ার ধারণাটি এই ইলেকটোরাল ব্যবস্থার ফলে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। এ ব্যবস্থার প্রণয়নকারীরা উদ্বিগ্ন ছিলেন, ভোটাররা যথেষ্ট জানাশোনার মাধ্যমে ভোটের সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য শিক্ষিত কিনা। তখন জাতীয় সাক্ষরতার হার কম ছিল এবং সেই সময়ে অন্য কোনো দেশই জনপ্রিয় ভোটের মাধ্যমে নেতাদের বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেননি।
জনগণের সরাসরি ভোটের এবং একক কারও হাতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের মধ্যবর্তী একটি পন্থা হিসাবে বেছে নেওয়া হয় এই ইলেকটোরাল কলেজকে। তাই তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, প্রতিটি রাজ্যে নিযুক্ত ইলেকটররাই রাষ্ট্রপতিকে ভোট দেবেন।
আমেরিকানরা তাহলে কাকে ভোট দেন
মার্কিন নাগরিকরা যখন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট দেন, তখন তারা আসলে সেই প্রার্থীর ইলেক্টরদের ভোট দেন। বেশির ভাগ রাজ্যে কোনো প্রার্থী জনগণের ভোটে জয়ী হলে পুরো রাজ্যের ইলেকটরদের ভোট পান। উদাহরণস্বরূপ, ক্যালিফোর্নিয়ায় সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে কমলা হ্যারিস বিজয়ী হলে তিনি সে রাজ্যের ৫৪টি ইলেকটোরাল ভোটই পাবেন।
মাইন ও নেব্রাস্কায় অবশ্য পদ্ধতি ভিন্ন। এ দুই রাজ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটের ভিত্তিতে নির্বাচিত প্রার্থীকেই সব ভোট দেওয়া হয় না। এ দুই রাজ্যে জনগণের ভোটের হারের ওপর ভিত্তি করে ইলেকটোরাল ভোটও প্রার্থীদের মধ্যে ভাগ করা হয়।
এমন কোনো সাংবিধানিক আইন নেই, যেখানে রাজ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট পাওয়া প্রার্থীকেই ভোট দিতে ইলেকটোরাল ভোটাররা বাধ্য। তবে রাজ্যের ভোটারদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে ইলেকটোরাল কলেজের ভোট দেওয়া একেবারেই বিরল। ইউএস অফিস অব ফেডারেল রেজিস্ট্রার অনুসারে, মার্কিন ইতিহাসে ৯৯ শতাংশেরও বেশি ইলেকটোরাল ভোটার তাদের অঙ্গীকার অনুযায়ীই ভোট দিয়ে এসেছেন।
জনপ্রিয় ভোটে হেরেও কি কেউ প্রেসিডেন্ট হতে পারেন?
মার্কিন ইতিহাসে পাঁচবার এমন ঘটনা ঘটেছে। ২০১৬ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প জনপ্রিয় ভোটে প্রায় ৩০ লাখ ভোটে পিছিয়ে থাকলেও ইলেকটোরাল কলেজে জিতেছিলেন। জর্জ ডব্লিউ বুশ জনপ্রিয় ভোটে হেরে গেলেও ২০০০ সালে আল গোরের বিরুদ্ধে ইলেকটোরাল কলেজে জয়ী হন। ১৮ শতকেও এমন ঘটনা তিনবার ঘটেছিল।
কোনো প্রার্থী সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে কী হবে
দুই প্রার্থীই ২৬৯টি করে ইলেকটোরাল কলেজ ভোট পেয়েছেন, এমন ঘটনা ঘটলে হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভসকে বিজয়ী নির্ধারণের দায়িত্ব দেওয়া হয়। প্রতিটি রাজ্য প্রতিনিধি একটি ভোট পায় এবং জয়ের জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠ (২৬) ভোট প্রয়োজন হয়। মার্কিন নির্বাচনের ইতিহাসে অবশ্য কখনই ইলেকটোরাল কলেজের ভোটে দুই প্রার্থীর সমান সমান ভোট পাওয়ার ঘটনা ঘটেনি।
বিজয়ী কখন ঘোষণা করা হয়
কংগ্রেস ৬ জানুয়ারি ভোট গণনা করে এবং ২০ জানুয়ারি প্রেসিডেন্টের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনের দিন ফলাফল আসার সময়ই সাধারণত বিজয়ী কে সেটা স্পষ্ট হয়ে যায়। ফলে ৬ জানুয়ারির ঘোষণা সাধারণত আনুষ্ঠানিকতাতেই পর্যবসিত হয়। তবে ভোট গণনা করতে কিছু ক্ষেত্রে বাড়তি সময়ও লাগতে পারে। ২০০০ সালে জো বাইডেনকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয় ৭ নভেম্বর, নির্বাচনের দিন ৩ নভেম্বরের চার দিন পর।